বাংলাবাজার আঞ্চলিক যুবদলের উদ্যোগে আলোচনা সভা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
ভোলার ইলিশায় তারেক বাবু হত্যার ঘটনাটি এখন ভূমিদস্যুদের জমি দখলের খোরাক
এইচ এম জাকির ॥ ভোলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পূর্ব চরনন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা আলোচিত তারেখ বাবু হত্যার ঘটনাটি এখন ভুমিদস্যুদের জমি দখলের খোরাকে পরিনত হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই হত্যাকান্ডের বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে ভূমিদস্যু হিসেবে খ্যাত স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
অভিযোগ রয়েছে, পাশের ইউনিয়ন রাজাপুরের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল উদ্দিন হাওলাদারের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু চক্র বহু বছর যাবত রাজাপুর, পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়ন সহ বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের বিভিন্ন চরে বহু সরকারী ও ব্যক্তি মালিকানা জমি জবরদখল করে আসছে। চক্রের মুল হোতা হেলাল মেম্বার সহ তাদের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে জমি সংক্রান্ত একাধিক মামলা থাকা সত্বেও অন্যের জমি জবরদখল যেনো তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে দাড়িয়েছে। তেমনই ভাবে জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই চক্রটি সম্প্রতি ওই এলাকায় ঘটে যাওয়া তারেক বাবুকে হত্যা করার মতো লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসছে এক এক করে চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য। প্রায় ৩০ বছর যাবত পশ্চিম ইলিশা ও রাজাপুর ইউনিয়নের প্রায় ২৫/২৬ একর জমি উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ দখল করে আসছেন সেখানকার বাসিন্দা কামাল সিকদার, শফিক খান, নাছির ফকির, হারুন ফকির, কবির মঞ্জু সহ প্রায় ২০ পরিবার। বছর ছয়েক আগে ওই সকল জমির উপর মালিকানা দাবি করে রাজাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল উদ্দিন হাওলাদার, মোকতার হাওলাদার, নিজাম দেওয়ান, মিনটু দেওয়ান, আবুতাহের, আলী আকবর, হানিফ শিয়ালী, ফয়সাল হাওলাদার, রাকিব দফাদার সহ সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু চক্রের প্রায় ১৫/২০ জন সদস্য। এরপর থেকেই জমি দখল নিতে শুরু হয় বিভিন্নভাবে মামলা হামলা। তবুও কামাল সিকদার, শফিক খান ও হারুন ফকির গংদের মালিকানাধীন জমি জোরপূর্বক দখল নিতে ব্যর্থ হয় হেলাল মেম্বার গংদের নানা মিশন।
অবশেষে গত ২৮ মার্চ সোমবার সন্ধ্যার পর পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পূর্ব চরনন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা সকলের প্রিয় মূখ তারেক বাবুুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে হেলাল মেম্বর গংদের জমি দখল মিশনের প্রথম ধাপের সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। কে বা কাহারা কেন বা কি কারণে বাবুকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে তা এখনো সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে না পারলেও নিহত তারেক বাবুর পরিবারকে ফুসলিয়ে তার বোনকে বাদি করে ওই জমির মালিক কামাল সিকদার, শফিক খান ও হারুন ফকির, নাছির ফকির সহ ১২ জনকে আসামি করে ভোলা সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর পুলিশ এক এক করে ওই মামলার অধিকাংশ আসামিকেই গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
এদিকে ওই জমির প্রকৃত মালিক কামাল সিকদার, শফিক খান ও হারুন ফকির, নাছির ফকির সহ ১২ জনকে তারেক বাবু হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি করার পাশাপাশি তাদেরকে গ্রেপ্তার করার পরপরই শুরু হয় ভূমিদস্যু হিসেবে খ্যাত হেলাল মেম্বার গংদের জমি দখলের মিশন। তারা কালাম সিকদার গংদের বেশ কিছু জমি দখল সহ ভেকু দিয়ে মাটি কেটে বেড়িকেট দিয়ে সেখানে শুরু করেছে বালুর ব্যবসা। লুটে নিয়ে গেছে ঘেরের মাছ, গাছের কলাসহ বহু ধরনের ফলফলাদি। কেটে ফেলা হয়েছে কয়েকটি বাগানের রোপন করা বহু ধরনের চারা গাছ। এ ধরনের নেক্কার জনক ঘটনায় জমির ওয়ারিশগনের অধিকাংশরাই কারাগারে থাকায় তাদেরই একজনের বোন ও জমির প্রকৃত মালিক মৃত হাবিবুর রহমান সিকদারের স্ত্রী মমতাজ বেগম বাদি হয়ে রাজাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল উদ্দিন হাওলাদারকে প্রধান করে ৮ জনকে আসামি করে ভোলার আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ ব্যাপরে মামলার বাদি মমতাজ বেগম বলেন, আমাদের জমিজমা জোরপূর্বক দখন নিয়ে এই এলাকার মেম্বার ভূমিদস্যু হেলাল উদ্দিন গংরা বহু বছর যাবত আামাদের বিরুদ্ধে মামলা হামলাসহ নানা ভাবে আমাদের উপর নির্যাতন নিপিড়ন চালিয়ে আসছে। কোন ভাবেই আমাদেরকে পরাজিত করতে না পেরে অবশেষে হেলাল মেম্বার তার নিজের লোক দিয়ে এই এলাকার নিরিহ ছেলে তারেক বাবুকে বিনা কারণে হত্যা করে সেই ঘটনায় মামলা দিয়ে আমাদের প্রতিটি মানুষকে আসামি করে এখন জেল হাজতে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তারেক বাবুর পরিবারের সাথে আমাদের কারোরই কোন ধরনের বিরোধ ছিলো না। শুধুমাত্র আমাদের উপর দোষ চাঁপাতে এমনকি মিথ্যা নাটক সাজিয়ে আমাদেরকে ফাঁসানোর জন্যই পরিকল্পিত ভাবে এই নিরিহ ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছে।
একই ভাবে তারেক বাবু হত্যা মামলার জামিনে বের হওয়া অপর আসামি মিজানুর রহমান হারুন বলেন, বাবু হত্যার ঘটনাটি ঘটার সময়ে আমি ছিলাম স্থানীয় মসজিদে তারাবির নামাজ পড়া অবস্থায়। তাহলে এই হত্যাকান্ডের সাথে আমি জড়িত হই কি ভাবে। আমি নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হতেই পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। এখানে যে বাবুকে হত্যা করা হয়েছে বা আমি যে সেই মামলার আসামি তা কোন ভাবেই আমি অবগত ছিলামনা। আর আমি যদি এ ঘটনায় জড়িতই থাকি তাহলে আদালত কেনইবা এতো দ্রুত এই হত্যা মামলায় আমাকে জামিন দেবে।
তিনি আরো বলেন, এমনকি এই মামলায় আামদের যে সকল লোকদেরকেও আসামি করা হয়েছে তাদের কেউই এ ঘটনার সাথে জড়িত কিংবা এ বিষয়টি সম্পর্কে কোন ভাবেই অবগত ছিলো না। তা না হলে কোন মামলার আসামি কি এতো বড় একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পুলিশের সামনে ঘুরে বেড়ায়।
এদিকে তারেক বাবু হত্যার ঘটনাটি পরিকল্পিত আখ্যাদিয়ে এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তারা এ কাজের সাথে জড়িত নয় বলে দাবী করছেন স্থানীয়রা। এমনকি হত্যাকান্ডের বিবরণী থেকেও তারেক বাবুর পরিবার ও স্থানীয়দের কাছ থেকে বেড়িয়ে আসছে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, তারেক বাবু হত্যাকান্ডের পূর্বে একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সাযোগে ইলিশা পরানগঞ্জ বাজার থেকে বাড়ির উদ্দ্যেষ্যে রাওনা হয় তারেক বাবু, আলী আকবর শিয়ালী ও হেলাল মেম্বারের পুত্র হাসিব হাওলাদারসহ তারা তিন জন। তাদের এলাকায় পৌছানোর আগেই যেই স্থানটিতে বাবুকে নির্মম ভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো, প্রথমেই সেই স্থানে বড় বড় গাছের গন্ডি ফেলে তাদের রিক্সাটির গতিরোধ করা হয়। তার পূর্বেই তাদের সাথে থাকা হেলাল মেম্বারের পূত্র হাসিব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ী থেকে নেমে যায়। সে গাড়ী থেকে নামতেই একটু সামনে যেতেই রাস্তায় গাছের গন্ডি ফেলে বেড়িকেটের মধ্যে আটকে দেয়া হয় তাদের রিক্সাটিকে। মুহুর্তের মধ্যেই এক দল সন্ত্রাসী এলোপাতারি হামলা শুরু করেন তারেক বাবুর উপর। এ সময় রিক্সায় থাকা আলী আকবর শিয়ালী সেখান থেকে সটকে পড়লে সন্ত্রাসীরা তারেক বাবুকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মূমুর্ষ অবস্থায় তাকে নেয়া হয় হেলাল মেম্বারের বাড়িতে। এরপর সেখানে দীর্ঘ সময় তাকে রেখে ভোলা থেকে এ্যাম্বুলেন্স গিয়ে তাকে নিয়ে আসে ভোলা সদর হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি দেখে রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই ভোলার বাহিরে নেয়ার পথে সে মারা যায়।
তবে হত্যাকান্ডের বিবরণী ও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অন্তর্ভূক্ত আসামীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে আসাসীদের পরিবার ও স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে নানান ধরনের প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, পরানগঞ্জ বাজার থেকে রিক্সা যোগে তিনজন একসাথে রওনা হয়ে ঘটনার পূর্ব মূহুর্তেই কেনোইবা হেলাল মেম্বারের ছেলে রিক্সা থেকে নেমে গেলো। রিক্সায় থাকা আলী আকবর শিয়ালী কেনোইবা নিজের সহপাটিকে রেখে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এমনকি যানবাহন চলাচলের প্রধান সড়কটিতে দীর্ঘ সময় গাছের গন্ডি ফেলে রাখার মূহুর্ত না হলেও ওই মূহুর্তেই কে গাছের গন্ডি ফেলে তাদের পথ অবরুদ্ধ করেছিলো। আর হামলাকারীরা কিভাবে বুজতে পারলো যে তারেক বাবু হামলাকারীদের পাতা ফাঁদের কাছে চলে এসেছে। তাছাড়া তারেক পরানগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার কাছে থাকা লোকজন ব্যতিরেকে তার চলাচলের খবরাবর হামলাকারীদের কাছে অন্য কারো দ্বারা পৌছানো সম্ভব নয় বলেও অনেকের ধারণা।
তবে ভোলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই চৌকষ। বিশেষ করে ভোলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (বিপিএম, পিপিএম) মহদয়ের বিগত দিনের এ ধরনের বহু ঘটনার মুল রহস্য উদঘাটনের মধ্য দিয়ে তিনি যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার প্রতি ফলন হিসেবে এই ঘটনারও মুল রহস্য উদঘাটন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
অন্যদিকে ঘটনার মূল মাষ্টারমাইন্ড ও ওই এলাকার ভূমিদস্যু হিসেবে খ্যাত রাজাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল উদ্দিন হাওলাদারের সাথে কথা বলতে চেয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তাকে পাওয়া গেলেও এই ঘটনার সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এই প্রতিবেদকের ফোনটি তিনি কেটে দেন।
যদিও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরকেও গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ভোলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রিপন চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, এ ঘটনার পুরোপুুরি বিষয়টি আমাদের কাছে তদন্তাধীন রয়েছে। আশা করছি খুব শিঘ্রই এর মূল রহস্য উদঘাটন করার মধ্য গিয়ে এর অন্য কেউই জড়িত থাকলেও তাকেও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আইনেই আওতায় আনা হবে।