সর্ষে ভূত, তালিকা নেই অধিদপ্তরে !

চরফ্যাশনে ইট ভাটায় পুড়ছে কাঠ

* আমার ভাটায় কোন সাংবাদিক আসার সাহস রাখে না বললেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল আমিন মুন্সি।

* সংবাদ না করার জন্য বিভিন্ন মহলে তদবির।


আদিত্য জাহিদ, চরফ্যাশন ॥ চরফ্যাশনে উপজেলার সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে ইট ভাটা। চরফ্যাশনে অধিকাংশ ভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা, সংরক্ষিত বন সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করেছে অবৈধ ইট ভাটা। শুধু তাই নয়, ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট ব্যারেলের (টিনের) চিমনি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইট ভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রভাবশালী হাত বদল করে দীর্ঘবছর যাবৎ চলছে প্রায় ২০টি ইট ভাটা। প্রশাসন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে না জানার ভান করছে।
সরজমিনে ইট ভাটায় ঘুরে দেখা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে আবাদী জমি। অনিয়শ্চতা দেখা দিয়েছে আগামীর ভবিষ্যত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইট ভাটা গড়তে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতাংশ) জমি প্রয়োজন। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ৪০ থেকে ৪৫ একর জমিরও প্রয়োজন হয়। একটি অবৈধ ইট ভাটা গড়ে ওঠার কারনে চার শতাধিক একর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইট ভাটার ম্যানেজার জানালেন, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। সেই মাটির জোগান আসে কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে ৫ থেকে ৬ একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরও জানান, ইট পোড়ানোর জন্য প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৪০০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত কাঠ এসব ভাটায় জোগান দেন। গড়ে প্রতিটি গাছ থেকে সাত থেকে আট মণ কাঠ পাওয়া যায়।
ভাটায় ঘুরে দেখা গেছে, আম, জাম, রেইনন্ট্রি, কদম, জামরুল, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেল সহ তিন শতাধিক ফলজ ও বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে প্রতিদিন। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অর্থ দন্ড জেল, বা লাইসেন্স বাতিল ও ইট ভাটা বাজেয়াপ্তর বিধান রয়েছে। কাগজে-কলমে এসব আইন বাস্তবায়ন কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে উল্টো নীতিতে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সহ জেলা উপজেলা প্রশাসন।
গত বছর আখন ও রাত্রি ইটভাটা গুড়িয়ে দিলেও চলতি বছর পুর্বের প্রক্রিয়ায় বাজার জাত করছে ইট। ১ মাস পরেও হালনাগাদ কোন তথ্য নাই বনও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ভোলা তোতা মিয়ার কাছে। তোতা মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, চরফ্যাশনে বৈধ কতটি ইট ভাটা রয়েছে তা এ মুহুর্তে বলতে পারব না। আপনি অফিসে আসলে ফাইল দেখে বলে দিব।
এদিকে, ইট ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, হাট-বাজার এলাকা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর এবং বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না। সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের বাহিরে ইটভাটা করার বিধান থাকলেও খোদ সংরক্ষিত বনেই রয়েছে অধিকাংশ ইট ভাটা। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই অধিকাংশ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ফসলি জমিতে।
ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ ছাড়াও স্থানীয়রা নানা ধরনের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। চরফ্যাশন উপজেলার দৌলতগঞ্জ গ্রামের কৃষক রহিম ইসলামসহ নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় ফসলের উৎপাদন কমে গেছে।
চরফ্যাশন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক জানান, ইটভাটায় ঝিকঝাক পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারনে ভাটার আশে পাশের ফসলি জমির উৎপাদন দিনদিন হ্নাস পাচ্ছে। ধানের চেয়ে চিটার পরিমান বেড়ে যাওয়া সহ অনান্য ফসলের ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইট ভাটা স্থাপন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে।
স্থানীয়রা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে শ্বসনতন্ত্রের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতাও বেড়েছে। চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শোভন বসাক আমাদের সময়কে জানান, ইট ভাটার ধোয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতার কারনে মানুষের চর্মরোগ, এ্যাজমা, হাপানিসহ ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ দেখা দেয়।
এ বিষয়ে ইটভাটা মালিক উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জানান, আমার ভাটায় কোন সাংবাদিক আসার সাহস রাখে না। বৈধ না অবৈধ তা পরের বিষয়।
২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোলা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহ পরিচালক মো. তোতা মিয়া বলেন, চরফ্যাশনে ভাটাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এই বিষয়টি আমার জানা ছিলনা, আমি সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব।
বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অবৈধ ইট ভাটা বন্ধের নির্দেশ সর্ম্পকে জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী’র সাথে (গত ৩ জানুয়ারী) আলাপ করলে তিনি জানান, নির্দেশ পেয়ে আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক ও অতিরিক্ত দায়িত্বে রাজস্ব তামিম ইয়ামিনকে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কার্য বন্টন করে দিয়েছি।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।