রাষ্ট্রহীন নাসেরি অব শেষ চিরবিদায় নিলেন

জীবনের টানা ১৮টি বছর ফ্রান্সের বিমানবন্দরে কাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই ইরানি বংশোদ্ভুত মেহরান করিমি নাসেরি মারা গেছেন। শনিবার (১২ নভেম্বর) ফরাসি বিমানবন্দরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। তাকে নিয়ে হলিউডে টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ‘দ্য টার্মিনাল’ ছবিটি সাড়া ফেলেছিল ব্যাপক। তবে এতোকিছুর পরও বিমানবন্দর থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারেননি তিনি।
সরকার বিরোধী আন্দোলনের দায়ে নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন মেহরান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর ইউরোপের কঠোর অভিবাসন নীতির চাপ তাকে বাধ্য করে ‘রাষ্ট্রহীন’ তকমা নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে।
১৯৪৫ সালে ইরানের খুজেস্তান প্রদেশে ইরানি বাবা ও ব্রিটিশ মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মেহরান। মেহেরান করিমী নাসেরি ইরানের মসজিদ সোলায়মান নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা পেশায় একজন ডাক্তার ও মা একজন সেবিকা ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডে যান লেখাপড়া করতে।
১৯৭৭৫ এ দেশে ফিরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দায়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। পাসপোর্ট ছাড়া বের করে দেয়া হয় দেশ থেকে। সেই থেকে শুরু মেহরানের যাযাবর জীবন। এরপর একে একে যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে আশ্রয় চেয়েও ব্যর্থ হন মেহরান। তাকে ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বেলজিয়াম। প্যারিসের রেল স্টেশন থেকে হারিয়ে যায় সে সার্টিফিকেটও। বৈধ কাগজপত্রের অভাবে জেল খাটা হয়ে ওঠে নিয়মিত ঘটনা। তবে রাষ্ট্রহীন বলে কোনো কারাগারেই বেশিদিন আটক থাকতে হয়নি মেহরানকে। এভাবেই একসময় ঠাঁই হয় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসেবে বিবেচিত ফ্রান্সের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে। এয়ারপোর্টই হয়ে ওঠে মেহরানের বাড়িঘর। প্লাস্টিকের সিট হয় বিছানা।
একসময় বিমানবন্দরের কর্মীদের সাথে মেহরানের সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারাই তাকে খাবার, পানি আর পত্রিকা সরবরাহ করতো। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও মিলতো বিমানবন্দরের চিকিৎসকের মাধ্যমেই। নিয়ম করে নিজের দিনলিপি টুকে রাখতেন মেহরান।
১৯৯২ সালে ফ্রান্সের হিউম্যান রাইটসের পক্ষ থেকে তার পক্ষে আইনি লড়াই লড়লেও ফ্রান্স ঢোকার অনুমতি পাননি। এক সময় মেহরান বলেছিলেন, এখানে জীবনযাপন খারাপ নয়। আমি সুন্দর সময় কাটাতে চেষ্টা করি। প্রতিদিন অতীতের কল্পনা করি। ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবি। নিজের দিনলিপি লিখে রাখি।
ধীরে ধীরে বিমানবন্দরের যাত্রীদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে দুর্ভাগা মেহরান। আলফ্রেড মেহরান বা স্যার আলফ্রেড নামেও পরিচিতি পান তিনি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসে তার নাম। এরপরই একদিন নজরে আসেন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের। মেহরানের জীবনী ভিত্তিক ছবি ‘দ্য টার্মিনাল’ মুক্তির পর আলোড়ন তোলে বিশ্বজুড়ে।
১৯৯৯ সালে বেলজিয়াম সরকার মেহরানের হারিয়ে যাওয়া কাগজপত্র ফিরিয়ে দেয়। ফ্রান্সে প্রবেশের অনুমতিও পান মেহরান। কিন্তু ভয়ে আর বিমানবন্দর ছাড়েননি মেহরান। ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। একটা সময় গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে পরবর্তী কয়েক বছর প্যারিসে ভাড়া থাকতেন তিনি।
কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ ফিরে আসেন চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে। শনিবার সেখানেই হার্ট অ্যাটাক হয় তার। মনের অজান্তেই কি মেহরান বুঝতে পেরেছিলেন, শেষ হয়ে এসেছে তার সময়; তাই ফিরে গিয়েছিলেন সেই বিমানবন্দরে!

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।