মধ্যরাত : পর্ব-৯১

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন), 

(গত পর্বের পর) : এক বন্ধু বলে উঠল, আর একটু এগিয়ে গেলেই তো ফ্লোরিডা। চলনা আমরা ডিজনী ওয়ালর্ডটা ঘুরে আসি। সকলেই তো হো করে হেসে উঠল। বলল সকলে পরে দেখা যাবে। আমি চুপ করেছিলাম। সুশীল বলল, কি প্রশান্ত বাবু আপনি চুপ করে আছেন যে, আপনি যাবেন না ? আমরা গেলে আপনাকে যেতে হবে তা-ত নিশ্চিয়। আমি বললাম, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস আসুক, তখন দেখা যাবে।
অমিয় বলল, প্রশান্ত বাবু মিস ডোরা ওনাকে আপনি জানিয়ে দেবেন, আমি বললাম আচ্ছা। সেদিনের মত গল্প-গুজব করে বাসায় চলে এলাম। মনটা যেন কেমন হাল্কা কবুতরের মত উড়ে চলল। সমস্ত মানবিক তুচ্ছ আশা, নিরাশা, মান-অভিমান শুদ্ধ আকাশের প্রশান্ত ধারায় কোথায় ধুয়ে মুছে গেল। মাটির ক্ষুদ্র ছাড়িয়ে অসীশ অনন্ত লোকে হারিয়ে গিয়ে ধন্য হল মন, মধুর হল অনুভব, স্বর্গী হল চেতনা। মনে হল কে যেন আমায় ঢাকছে। মনে হচ্ছে কার চিরন্তন বিরহে তার মধ্যে আকুল কান্না যোগাচ্ছে, কি এক অনির্ব্বচনি। এ বিরহের শেষ নেই, এ বিরহের কুল নেই, এ বিরহ যেন জন্ম জন্মান্তরের। শিল্পীর ডাকের মত আমায় টেনে নিয়ে গেল সেই বি.এম কলেজ (বরিশাল) স্টীমার ঘাটে। যেখানে ডোরার সাথে আমার মন দেয়া-নেয়া হয়েছিল। কত বছরের কথা, তখন বয়ষ চিল কুড়ি বা বাইশ। সেই উদ্দামতা, সেই চঞ্চলতা, চপলতা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আজ হাজার অনুনয়, বিনয় করেও তাকে আর ফিরে পেতে পারিনা।
ডোরারও তাই, সেই মন ওর হারিয়ে গেছে। সেই আঠারো বছরের ডোরার সেই কচি কোমল সবুজ মনের রং মুছে গেছে। সেখানে ভর করেছে কঠোর বাস্তব গম্ভীরতা। যৌবন কারো চিরদিন থাকে না। সেটা জানি বলে হতাশায় ভেঙ্গে পরিনি। ডোরাকে ভুলতে গেলে মনের কোথায় যেন দুঃখ পাই। অথচ ভালবাসায় জড়িয়ে থাকতে চাইলে মনের কোনে যেন স্বস্তি পাইনে। কয়দিন পূর্বে ডোরার চিঠি পেয়েছি, মামুলী চিঠি। প্রেম ভালবাসার বিন্দু মাত্রও কথা নেই। কেমন যেন কাঠ খোট্টা ভাষা। একবার দেখে বালিশের নীচে রেখে দিয়েছি। আমি যে কি লিখব তা চিন্তা করে হাদিস পাচ্ছিনা। আর তা ছাড়া বন্ধু-বান্ধবরা যে ভাবে লেগেছে পিছনে, ভার্জিনিয়ায় না গিয়ে ছাড়বেনা। অমিয় ভীষণ একগুয়ে, সুশীলও তার চেয়ে কমনা।
আমিও ডোরার কাছে অনেক দিন চিঠি দেইনি। যাক বন্ধুদের যাওয়ার কথা নিয়েই ওকে লেখা যাক। দেকি ওর মনের ভাব। ওরাত ডোরাকে অনেক নিমন্ত্রণ করে খাইয়ে দিয়েছে। তার কৃতজ্ঞতার কি রূপ রেখা মিলে। রাতের প্রায় তখন ১১টা বেজে গেছে। আমার যেন ঘুম আসছেনা। কত কথা, কত স্মৃতি, কত মধুমাস, কত মধুরাত। এর বিনিদ্র রজনীর ঢেউয়ের পরে ঢেউ যেন আমার মন মন্দিরে আছরে আছরে পরছে। আমি আমার মনকে অনেক শান্ত করবার চেষ্টা চালিয় চোখ বুজে থাকলাম। গভীরে ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর ঘুম, যেন কার ¯েœহ শীতল হাতের ছোয়ায় আমার মনে প্রাণে পরশ বুলিয়ে গেল।
মাকে আমার বেশি মনে পরে না। খুব ছোট থাকতেই মা চলে গেল। তবে একটু একটু আবছা আবছার মত মায়ের মুখখানা আমার স্মৃতির পটে ভেসে উঠে। বড় কল্যাণময়ী ছিল আমার মা। বড়দির কাছে শুনেছি বাবার জন্যই ছিল মার দুটি হাত সব সময় সচল। বাবার খুশিতে মা খুশি, বাবার দুঃখে মা অসুখী। পতি পরায়ন সতী সাধ্বী থাকতেন। মা নাকি খুব সুন্দরী ছিল। অথচ নিজের প্রসাধনটুকু পর্যন্ত মা করতে পারতেন না। বাবা-মাকে সব সময়ে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করতেন। আমার বাবা রাজনীতিবীদ, আইনজ্ঞ, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ। সামাজিক প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাজনীতিবীদ। আজ বাবাও নেই, মা অনেক আগেই চলে গেছে। যেসব কথা ভাবতে ভাবতে অনেক রাত অবধি এপাশ ওপাশ করলাম। খুব ভোরে উঠে নাশতা সেরে কলেজে (ইউনিভার্সিটি) তে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম। আজ জানি মনটা বড় চঞ্চল হয়ে আছে।

(চলবে——)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।