প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেউ তা মনে রাখে না

দূর্ভোগেই বসবাস ভোলার বিচ্ছিন্ন মদনপুরবাসীর

চারপাশে মেঘনা আর এর বুকে গড়ে উঠেছে দ্বীপ চর। যার নাম মদনপুর। নদীতে বাড়ীঘর হারিয়ে এই চরে ভিটেমাটি করে বসবাস করছেন হাজার হাজার পরিবার। জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে থাকা, নদী সাঁতরে যাতায়াত করা, কমিউনিটি ক্লিনিক তালাবদ্ধ থাকা, ভাঙণে জনপদ ক্ষয়ে যাওয়া, অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে না পারা, ডিজিটাল ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেও বাস্তবায়ন হয়নি। দুইমাসের বেশি বিদ্যুৎ বিছিন্ন মদনপুর।
সরেজমিন ঘুরে দেখা উপকূলের দ্বীপ জেলা ভোলার চর মদনপুরের এখনকার অবস্থা এমনই। সেই অভাবী মানুষ, সেই বিপন্ন রাস্তাঘাট, সেই ভাঙণ কিনারের খেয়াঘাট ইটের সলিং ছাড়া ইঞ্চি রাস্তাও পাকা নাই। জোয়ারে পানি বাড়লে মানুষদের এখনও গন্তব্যে ফিরতে হয় সাঁতরে। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও একইভাবে পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়ে। চাষিরা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন সবুজ ধানক্ষেতের দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফসল ঘরে উঠবে কিনা, তা জানে না তারা। কারণ দুর্যোগ এদের পিছু ছাড়ে না আবার বৃষ্টি বা জোয়ার কমলেও জলাবদ্ধতা তাদের ফসলের বাধা হয়ে দাড়ায়।
বিছিন্ন মদনপুরের মানুষরা অসুখে ঔষুধ মেলে না। মুমুর্ষু রোগী নিয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কোন পথই থাকে না। চরের কেন্দ্রীয় পাটোয়ারী বাজারের চরটগবি এলাকায় একটিমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক গিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। ক্লিনিকের কর্মী সৌরভ আসেন মেঘনার ওপার থেকে। তার আসা-যাওয়া নির্ভর করে নদীর অবস্থা ও আবহাওয়ার ওপর। আর এর ভোগান্তি চরের মানুষের ওপর। কোনমতে ওষুধের নাম জানা কয়েকজন গ্রাম ডাক্তার এই চরের মানুষদের ভরসা।
চরের এক প্রান্ত চর পদ্মা। মদনপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় ছুটে এলেন অনেকজন নারী-পুরুষ। তাদের অনেক অভিযোগ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা চরম সংকটে রয়েছেন। কথা বলতে বলতে অভিযোগকারীদের দল ভারি হয়, তালিকা লম্বা হতে থাকে অভিযোগের। বাজারের দোকানদার হিরন, ইউসুফ, আবুল কালাম, হাবিবুল্লাহ, মোটরসাইকেল ড্রাইভার, জামাল, গৃহিণী কমেলা বেগম। প্রত্যেকেরই পৃথক সমস্যা।
এই মানুষেরা সব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে এই চরে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ নিজের জমিতে, কেউবা থাকেন অন্যের জমিতে। মেঘনার দিকে তর্জনী উঁচু করে কয়েকজন বললেন, এই নদী সব শেষ করেছে। এখন আবার এই চরও গ্রাস করছে। এরপর আমরা কোথায় যাব ? তথ্য প্রদানকারী চরবাসীর মধ্যে কয়েকজন আবার ভাঙণের কারণে এরইমধ্যে কয়েকবার বাড়ি বদল করেছেন।
চরের মূল কেন্দ্র পাটোয়ারী বাজারে পৌঁছানোর আগেই বহু মানুষের ভিড়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যেও কয়েকজন আছেন। বাজারের সবচেয়ে বড় হোটেলে বসে আলাপের সময় বাসিন্দাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এখানকার প্রধান সমস্যা কোনটি। সবার এক উত্তর-আবহাওয়াজনিত সমস্যা। এখানকার মানুষেরা প্রতিনিয়ত ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন। বাতাসের ঝাপাটায় বাড়িঘর ভাঙে, জোয়ারে ডুবে মাঠঘাট। গত এক বছরে এখানে বড় কোন ঝড় না হলেও জোয়ারের পানিতে ডুবেছে কয়েকবার। স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবদিক থেকেই পিছনে বিছিন্ন মদনপুরবাসী।


শিক্ষাকে দ্বিতীয় সমস্যা হিসাবেই দেখালেন এলাকার মানুষেরা। সরকার প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে উপস্থিতির তথ্য দিলেও এই চরের ৬০ ভাগ শিশু এখনও স্কুলে যেতে পারে না বলে জানালেন চরের বাসিন্দারা। দারিদ্র্যের কারণে স্কুল গমনোপযোগী শিশুদের বড় অংশ নদীতে মাছ ধরে। চরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে এমন অনেক শিশুর দেখা মেলে।
মদনপুরার তৃতীয় সমস্যা স্বাস্থ্য-চিকিৎসা বলে অভিমত দেন এলাকাবাসী। এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে কিন্তু সেবা নাই। তালাবদ্ধ দেখা গেছে। চরের পল্লী চিকিৎসক জশিম উদ্দিন বলেন, এখানে প্রসবকালীন সমস্যাটাই সবচেয়ে মারাত্মক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই নেই। জরুরি ভিত্তিতে ভোলায় যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। ডায়রিয়া মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন পাওয়া যায় না। চরের শিশুদের নিউমোনিয়া দেখা দেয়।
চরবাসীর তালিকায় চতুর্থ নম্বরের সমস্যাটি স্যানিটেশন। যে পানিতে গোসল, সেই পানিতেই থালা-বাসন ধোয়ার কাজ সারতে হয়। টিউবওয়েল থাকলেও বেশির ভাগ সমস্যা, নষ্ট হলে মেরামতের লোক নাই। এরফলে চরের মানুষ পানিবাহিত নানান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়। পাকা লেট্রিন ব্যবহারে দেশ অনেক সফল বলে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার থাকলেও এই চরে পাকা লেট্রিন নেই বললেই চলে।
চরের বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য বলছে, এখানে যোগাযোগ, যাতায়াত, দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় অনেক সমস্যা এখনও রয়েছে।। পরিষদসহ দুইটি সাইক্লোন সেন্টার থাকলেও মানুষের মাঝে কিছুটা আশা জাগলেও বেড়িবাঁধ না থাকায় এখানকার মানুষের মাঝে শংকা থেকেই যায়। এলাকাবাসী বহুবার বেড়িবাঁধের দাবি তুললেও এ বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত যেতে খাল সাঁতরাতে হয়। পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা এখানে নেই।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার আওতাধীন এই চরটি ভোলা-২ আসনের অন্তর্ভূক্ত। লোকসংখ্যা প্রায় ১২ হাজারের ওপরে। এই মানুষগুলো নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতির কথা শোনে। কিন্তু নির্বাচনের পরে কেউ প্রতিশ্রুতি রাখেন না। বিশেষ কোন উপলক্ষ ছাড়া এই চরে মন্ত্রী-এমপিদের দেখা যায় না। সরজমিন দেখা যায় পরিষদ সংলগ্ন ২৭ লক্ষ টাকা ব্যায়ে একটি ব্রীজ এখনো রং নষ্ট হয়নি কিন্তু ব্রীজ ভেঙে চুরমার।
চরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যার নামে ওই চরের কেন্দ্রীয় বাজার যিনি স্কুল, মাদ্রাসা, বাজার ও কমিউনিটি ক্লিনিকের জমিদাতা লুৎফর রহমান পাটোয়ারী বলেন, শেখ হাসিনার উদ্যােগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ কিন্তু আমাদের চরে সেটা বাস্তবায়ন হলেও আবার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তিনি আরো বলেন, এই চরের ক্লিনিকে সব সময় চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন কিন্তু সপ্তাহে ও একদিন থাকে না, চিকিৎসার অভাবে মারা যায় অনেক গর্ভবর্তী মায়েরা বলেও জানান তিনি।
মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একে এম নাছির উদ্দিন নান্নু বলেন, মদনপুর চরে ইটের রাস্তা ছাড়া কোন পাকা রাস্তা নাই এই জলোচ্ছ্বাসে অনেক রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, যাতায়াতের কষ্ট হচ্ছে মানুষের। তিনি আরো বলেন, চরবাসীর বড় সমস্যা বলেন আর দূর্ভোগ বলেন সেটা হলো জলোচ্ছ্বাস আর বন্যা। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবার বেহালদশা, ক্লিনিক আছে সেবা নাই বলেও জানান তিনি। শিক্ষার কথা কি বলবো; শিক্ষকরা তাদের মনমত স্কুলে যায়, সপ্তাহে দুই একদিন যায়।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।