চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে জলবায়ু তহবিল সংগ্রহ

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগের দায় কার এবং এ জন্য কে ক্ষতিপূরণ দেবে, তা নিয়ে জার্মানির বন শহরে চলতে থাকা জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে কথার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বনের এ সম্মেলনকে বলা হচ্ছে আগামী নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের মহড়া (ড্রেস রিহার্সাল)। দুই সপ্তাহের বন সম্মেলনে এবারের মূল আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি, অভিযোজন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি কিভাবে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখা যায়। তবে এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচনায় আছে ধনী দেশগুলো, যারা কার্বন নির্গমনের জন্য বেশি দায়ী, তাদের কাছ থেকে কিভাবে জলবায়ু দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলো ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের নির্বাহী সচিব প্যাট্রিসিয়া এস্পিনোসা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আসছে নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলন গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬-এর মতো সহজ হবে না। কারণ বিশ্ব এখন দ্বন্দ্ব, শক্তি, খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে ঘেরা। বিশ্বব্যাপী মহামারি এখনো বিরাজমান। বন জলবায়ু সম্মেলন শুরুর কয়েক দিন পর এসে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন। তাঁরাও মনে করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে জলবায়ু তহবিল গঠনে লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে না। কারণ দাতা দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকাতে পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যস্ত। এ জন্য বেসরকারি পর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রতি নজর দেওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেন তাঁরা।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন জানান, জলবায়ু তহবিল গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ২০২৫ সাল থেকে এ খাতে তহবিল বাড়ানোর প্রস্তাব আছে। কিন্তু তহবিল সংগ্রহে গ্লাসগো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিষয়ে আলোচ্যসূচি তৈরির সম্ভাবনা কম। তহবিল গঠনের ব্যাপারে দাতা দেশগুলো কী মত দেয়, সবাই একমত হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
২০২০ সালে সাব-সাহারান আফ্রিকার মাথাপিছু বার্ষিক কার্বন নির্গমনের হার ছিল মাত্র ০.১ টন, যেখানে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের হার ছিল ১৭ টন। চলতি সপ্তাহে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদন অনুসারে, পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র ০.১ শতাংশের জন্য দায়ী। অথচ এই অঞ্চল চার বছর ধরে খরাপ্রবণ, লাখো মানুষের জীবন হুমকির মুখে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর চরম আবহাওয়ার সঙ্গে যে অভিযোজন করতে হচ্ছে, তা সমস্যার আংশিক সমাধান আনবে। কিন্তু তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, সে জন্য ধনী দেশগুলোকে দায় নিতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যারা ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশ, তারা কোনো দায় নিতে অস্বীকার করেছে এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থায়নে অঙ্গীকার করতেও রাজি হয়নি।
যার ফলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে চায় না। তারা বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের যে প্রস্তাব এসেছিল গ্লাসগো সম্মেলনে, তা নিশ্চিত না হলে ভারত জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা বাড়াবে না। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে আমি মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রগ্রামের মাধ্যমে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি রাখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক করণীয় নির্ধারণে আলোচনা করছি।
জিয়াউল হক বলেন, প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী কপে তহবিল গঠন বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ ভালো যায়নি। ২০২২ সালে ভালো কিছুর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দাতা দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে, যা উদ্বেগের বিষয়। তাঁর মতে, কপ-২৬-এর অর্জনগুলো ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক নানা সংকটের কারণে বাস্তবায়নের গতি ধীর।
তিউনিশিয়ার প্রতিনিধি মাতিউ ওয়েনার বলেন, পরাশক্তি দেশগুলো নিউক্লিয়ারের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামের ব্যবহার জলবায়ুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার কারণে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বলা যায়, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পরাশক্তি দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে। বড় দেশগুলোর স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বিশ্বাস ও আস্থার সংকট আছে। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী সম্মেলনে তহবিল গঠনসহ যেকোনো ইস্যুতে একমত হওয়া কঠিন হবে।
সুদানের প্রতিনিধি আরিগ গাফফার বলেন, ‘আমাদের কী দরকার আর আমরা কী করছি, সেই ভাবনা জরুরি। করোনাভাইরাস এখনো চলে যায়নি। সব দেশ মন্দার শঙ্কায় আছে। সবাই নিজ দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত। এখানে বসে শুধু আলোচনা করলেই হবে না। সমস্যা সমাধানে একমতে আসতে হবে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা জানান, এবার মূলত চারটি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো প্যারিস চুক্তির আওতায় প্রশমন, অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা ও বৈশ্বিক তহবিল গঠনে লক্ষ্য অর্জন। বাংলাদেশ ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা বাড়াতে জোরালো দাবি করছে। সুত্র : কালের কণ্ঠ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।