বিচলিত নয় আওয়ামী লীগ, আশাবাদী বিএনপি

আস্তে আস্তে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা শোনা যাচ্ছে। বিএনপি এখন প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করছে এবং সরকার পতনের ডাকও দিয়েছে। অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের নানা রকম সমালোচনায় এখন মুখর রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দৃশ্যমান রাজনৈতিক আন্দোলন লক্ষ্য করা যাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এর পাশাপাশি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক নানারকম চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে মেরুকরণ চলছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আস্তে আস্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তুলছে। এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। কিন্তু এসব নানারকম চাপের পরও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং আওয়ামী লীগ আশাবাদী যে, আগামী নির্বাচনেও সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে এবং এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। এমনটি মনে করছেন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীরা। এরকম ভাবনার পিছনে রয়েছে পাঁচটি কারণ।
১. শেখ হাসিনা : আওয়ামী লীগ মনে করে যে, বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং দৃঢ়তার কারণে তিনি এই সমস্ত চাপগুলোকে সহজে মোকাবেলা করবেন এবং চাপ উত্তরণ করে কাঙ্খিত বন্দরে নোঙ্গর করবেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন যে, শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই এবং এককভাবে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। এটি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশাবাদের বিষয়।
২. শক্তিশালী সংগঠন এবং কর্মী : আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা মনে করেন যে, অন্যান্য যেকোনো রাজনৈতিক সংগঠনের আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী এবং সংগঠিত। অভ্যন্তরীণ বিরোধ যাই থাকুক না কেন সংকটে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়, অতীতে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দলের ভেতর যে কোন্দল আছে সে কোন্দলগুলো কেটে যাবে এবং এই শক্তিশালী সংগঠন যেকোনো বিরোধী আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে পারবে।
৩. প্রশাসন : আওয়ামী লীগের আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো প্রশাসন। আওয়ামী লীগ মনে করে যে, প্রশাসন সবসময় আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। কারণ, আওয়ামী লীগ প্রশাসনে পদোন্নতি, বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গুলো দিয়েছে তাতে তারা অন্য বিকল্প চিন্তা করবে না। এ কারণেই প্রশাসনের সমর্থন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ইতিবাচক দিক।
৪. জঙ্গিবাদ ইস্যু : আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছরে সফলভাবে জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করেছে। আন্তর্জাতিক মহল আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ইস্যুতে সমালোচনা করলেও তারা জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন যে, বাংলাদেশ কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যেকোনো সময় এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে। এরকম একটি আতংক এবং উদ্বেগ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে আছে। আর এ কারণেই পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে যে, জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়ের পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আওয়ামী লীগকে বেছে নিবে পশ্চিমা দেশগুলো।
৫. ভারত : এখন পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষে এবং সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি বড় ফ্যাক্টর এবং এখন পর্যন্ত ভারত আওয়ামী লীগের কোন বিকল্প ভাবছে না। এটি আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক দিক বলেই অনেকে মনে করেন।
অন্যদিকে আশাবাদী হচ্ছে বিএনপি। তারা বলছে যে, সরকারের পতনের লক্ষ্যে তারা আন্দোলন করবে। আন্দোলন করার জন্য তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময়ও করছে। বিএনপি নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে এখন অনেকটাই আশাবাদী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা সরকার পতনের আন্দোলন করবে এমন হুমকিও দিচ্ছেন। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সেই পুরনো বাহাস আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতারা একদিকে যেমন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কথা বলছে, অন্যদিকে সরকারের নানা ব্যর্থতায় বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা শুরু করেছে। বিএনপি নেতাদের মধ্যে কিছুদিন আগেও যে হতাশা ছিলো সে হতাশাগুলো কাটতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে যে, কেন বিএনপি হঠাৎ করে আশাবাদী ? বিএনপির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে যে, তারা তারা মনে করছে যে, সরকারের অবস্থা অনেকটাই নাজুক এবং এখন আন্দোলন করার জন্য উপযুক্ত সময়। কেন বিএনপি আশাবাদী হয়েছে, এই কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে মোটামুটি পাঁচটি কারণে বিএনপি নেতারা এখন আগের চেয়ে আশাবাদী।
১. সরকারের নানা ব্যর্থতা : ১৩ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা এখন জনমনে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও হয়ে যাওয়া, নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং ব্যর্থতা এখন জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ক’দিন আগে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কা- সারা দেশে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল। একইভাবে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিগুলো সরকার সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না বলেই অনেকে মনে করেন। এটি বিএনপিকে আশাবাদী করে তুলছে।
২. আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল : কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেশ প্রকাশ্য রূপে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহে লিপ্ত হচ্ছে। এটাও বিএনপির জন্য ইতিবাচক বলে বিএনপির নেতারা মনে করছেন। তারা বলছেন যে, আওয়ামী লীগের যে সংগঠিত শক্তি সেই শক্তি এখন আর নেই এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন মোকাবেলা করার মতো ঐক্যবদ্ধ নয়।
৩. মার্কিন মনোভাব : বিএনপির আশাবাদী হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে মার্কিন মনোভাব। একের পর এক বাংলাদেশের ওপর নানা বিষয়ে শর্ত এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এর মাধ্যমে মার্কিন মনোভাব নেতিবাচক সেটা সুস্পষ্ট হচ্ছে । সাধারণ মানুষও মনে করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা এখন একটু শীতল। এটি এখন বিএনপির নেতারা তাদের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছে।
৪. জনগণের মধ্যে অস্বস্তি: জনগণের মধ্যে এখন নানা বিষয়ে অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। নিম্নআয়ের এবং মধ্য আয়ের মানুষ এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্যেই দিনযাপন করছে। অনেক বিষয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের নানা কর্মকা- মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করছে। এর ফলে বিএনপি মনে করছে যে, সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও কমেছে।
৫. বিশ্ব পরিস্থিতি : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব পরিস্থিতিতে একটা নতুন মেরুকরণ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে, সেখানকার মানুষ বিক্ষোভ করছে। পুরো টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতির ঢেউ এখনো বাংলাদেশে এসে লাগেনি। কিন্তু বিএনপি নেতারা মনে করছেন এর প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে পড়বে। আর এসব কারণেই তারা আশাবাদী। কিন্তু শুধু নিজেদের শক্তিতে বলিয়ান না হয়ে পারিপার্শ্বিক ঘটনা দিয়ে বিএনপি কি সত্যিই সরকারের কোনো অস্বস্তির কারণ হতে পারবে ? সুত্র : বাংলা ইনসিডার।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।