বছরে ১৮ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য

ভোলায় হাত বাড়ালেই মিলছে পাসপোর্ট !

সাইনবোর্ড দেখে বাইরে থেকে মনে হবে স্টুডিও, কম্পিউটার বা ফটোকপির দোকান। কিন্তু ভেতরে ব্যবসা ভিন্ন। প্রকাশ্যে চলছে পাসপোর্ট নিয়ে জাল-জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সিল প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যাবতীয় নকল কাগজপত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে পাসপোর্ট ! শহরের কালার টার্চ স্টুডিও, ফøাট বাড়ী, একাধিক আবাসিক হোটেল ও খোদ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনের দোকান ঘর ঘিরেই তৎপর পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্যরা। সরেজমিনে গত তিন মাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

ফলোআপ-২ :

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভোলায় প্রায় দুই ডজন জন চিহিৃত দালাল নিজেদের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের রেজিট্রার্ড এজেন্ট বলে পরিচয় দেয়, বেশিরভাগ পাসপোর্ট প্রত্যাশী ই-পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে গিয়ে এই দালালদের ফাঁদে পড়ছেন। ফরম পূরণ শেষ হলেই দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট করার অফার দেয়। পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য টাকার অংক ভিন্ন। যেমন: সিরিয়াল ছাড়া আবেদন জমা করতে ৫ থেকে ১৫ হাজার, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২০ হাজার, নামের বানান সংশোধনে সর্বনিম্ম ৩০ হাজার এবং জন্ম তারিখ সংশোধন ও নাম পরিবর্তন যেমন ভুয়া নাম-ঠিকানায় জাল পাসপোর্ট তৈরি, আঙ্গুলের ছাপ জালিয়াতি (মিসফিঙ্গারিং) ইত্যাদি কাজে বাবদ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে।
সুত্র বলছে, ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাসপোর্ট দালাল ভোলার বাণী’কে বলেন, ‘অফিসে তাদের লোক আছে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্যা শুনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তারা ফোন দেন। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর তারা কাজ হাতে নেন।’ কয়েকজন পাসপোর্ট দালাল আরও জানান, ভোলায় পাসপোর্ট দালালির কাজে তাদের প্রত্যেকের গড়ে দৈনিক আয় হয় ২ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া পাসপোর্টের ‘বড় কাজ’ পেলে তো কপাল খুলে যায়।
এ বিষয়ে ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দালাল নির্মূলে অফিসের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য জেলা পুলিশের সহায়তায় মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হয়। আগের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা হলেও দালালদের দৌরাত্ম্য কম।
সরেজমিনে দেখা যায়, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পাসপোর্ট সংক্রান্ত বহুবিধ সমস্যা নিয়ে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এদের একটি বড় অংশ পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে সমাধান পাননি অথবা চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। গত রোববার জাকির হোসেন নামের এক যুবক আসেন চরফ্যাশন থেকে। তার নামের আগে এমডি (সংক্ষিপ্ত মোহাম্মদ) ছিল। কিন্তু পাসপোর্টে এমডি প্রিন্ট হয়নি। অফিসের কর্তাব্যক্তিদের টেবিলে টেবিলে ঘুরেও সমাধান পাননি। অগত্যা এসেছেন দালালের কাছে।
লালমোহনের বাসিন্দা রফিকুজ্জামান শ্রমিক ভিসায় সৌদি যেতে চান। নতুন পাসপোর্ট করতে হবে। কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ভুল থাকায় পাসপোর্ট আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও সমস্যার সমাধান মেলেনি।
বোরহানউদ্দিনের বাসিন্দা আইনাল হকের স্ত্রীর ভোটার আইডিতে নাম আছে মোসা: খাদিজা খাতুন। কিন্তু নতুন প্রিন্ট করা ই-পাসপোর্টে খাদিজার নামের বানান ভুল হয়ে গেছে। তিনিও এখন সমাধান পাচ্ছেন না।
চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা থানা থেকে এসেছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জহুরুল হক। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন তিনি। জরুরি পাসপোর্ট দরকার। কিন্তু তিনি আবেদন জমার ডেট পাচ্ছেন না। এ কারণে তিনিও দালালের শরণাপন্ন হয়েছেন।
সূত্র বলছে, ভোলা লালমোহন উপজেলার মাঃ রাকিব হাসান ও বোরহানউদ্দিনের আবুল খায়েরের মাধ্যমেই ভোলায় পুরো নেটওয়ার্কটি কাজ করছে। এর পরেও রয়েছে লালমোহনের শহিদুল মেম্বার, ফারুক, সোহেল, চরফ্যাশন উপজেলার রেজাউল, তজুমুদ্দিন উপজেলার তোফায়েল, বোরহানউদ্দিন উপজেলার পবিত্র কুমার, দৌলতখাঁন বাংলাবাজার মোঃ রুহুল আমিন, ভোলা সদর মোঃ নোমান-১, নোমান-২, নাজমুল শিকদার, আব্বাস, মাসুম, হিরন, শাওন, জিহাদ সহ জেলার প্রায় দুই ডজন চিহিৃত দালাল প্রতিবছর ভোলার প্রায় কয়েক লাখ মানুষকে অসহায়ত্বর সুযোগ নিয়ে এই চক্রটি প্রতারিত করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্যর কথা অস্বীকার করেন এবং দালালদের দৌরাত্ম্যর কথা শিকার করে তিনি ভোলার বাণী’কে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ঠ, কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি; আশা করি খুব শিগ্রই এর কার্যকর সমাধানে আমরা যেতে পারবো।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।