সর্বশেষঃ

ভাসমান নৌকায় জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যু

জলে ভাসা জীবন ওদের

জলে ভাসা জীবন ওদের, নৌকায়ই বসবাস। আধুনিক সভ্যতায় মানুষ যেখানে উন্নত জীবন-যাপনে ব্যতিব্যস্ত সেখানে দু বেলা কোন মতে খেয়ে সংগ্রামী জীবন বেঁচে নিয়ে নৌকাতেই সেই মানুষেরই জন্ম, বিয়ে, সংসার ও মৃত্যুর ব্যাতিক্রম চিত্রও রয়েছে।
জানা গেছে, বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী মানতা সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো নৌকায় ভেসে ভেসে জীবন যাপন করছে। নদী কিংবা সাগরে নৌকায় মাছ শিকার করে চলে তাদের সংগ্রামী জীবন-সংসার। যে নদীর পানিতে তাদের গড়ে উঠে জীবন সংসার সেখানেই আবার মরন নিয়তি তাদের। নিজস্ব কোন জায়গা জমি না থাকায় মৃত্যুর পর আবার এই মানুষেরই দেহ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাতিক্রম জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এ মানুষগুলো ধর্মে মুসলমান হলেও মানতা সম্প্রদায় নামে পারিচিত।
এরা মাছ শিকার করে মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। পাশাপাশি কিছুটা হলেও দেশের অর্থনীতিতে এরা ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও এদের কারও কারও ভূমিকা আছে। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্বাদ কতটুকুই বা ভোগ করছে এরা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান সহ কোন মৌলিক চাহিদাই জুটছে না এদের ভাগ্যে। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান কিংবা বিশুদ্ধ পানির সুবিধা।
স্বাধীনতার প্রায় ৩৭ বছর পর সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার পেলেও নাগরিক হিসেবে কতটুকুই বা সুবিধা ভোগ করতে পারে এরা ? এদের ভোটে যারা জনপ্রতিনিধি তারাই বা কতটুকু খোঁজ রাখে এদের। প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্জা উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে রাত দিন একাকার করে মাছ ধরে কোন মতে জীবন চলে এদের। ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়ে চলে এদের দূর্বিষহ জীবন। নৌকা তীরে বেধে রাখে সরকারের বেধে দেওয়া নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। সচেতনতা ও সুযোগের অভাবে এদের সন্তানগুলো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সামান্য অক্ষর জ্ঞানও অর্জন করতে পারে না তারা। বড় হয়ে তাদের বেছে নিতে হয় মা-বাবার মাছ ধরার সেই জেলে পেশাকেই। শিক্ষার সুযোগ পেলে এদের মধ্যে থেকেও কেউ হয়ত বা আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। ভূমিকা রাখতে পারতেন দেশ ও জাতির উন্নয়নে।
মানতা সম্প্রদায়ে বিয়ে ও তালাকের বিষয়ে রয়েছে চমকপ্রদ তথ্য। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। যা এক ব্যতিক্রম ধর্মীয় বিয়ে এবং তালাক। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় যাওয়ার এ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঐ নারী হয় বধূ নয়ত তালাকপ্রাপ্তা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কারও কারও বিয়ে রেজিষ্ট্রীর মাধ্যমেও হচ্ছে। মানতা সম্প্রদায় শিক্ষিত না হওয়ায় এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অজ্ঞতার দরুন তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে না বিধায় দিন দিন এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাছ শিকারের সময় নৌকায় শিশু সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেধে রেখে পানিতে পড়ে যাওয়া হতে রক্ষা করা হলেও বিষয়টি অমানবিকও বটে, তবুও এর ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ তাদের অন্যতম রীতি। ছোট ছোট অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের কোল জুড়ে থাকে সন্তান।
তেমনি বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী ৩০টি মানতা পরিবারের সরদার কাশেম জানান, তিনি এ পর্যন্ত ৫টি বিয়ে করেছেন। একাধিক বিয়ে করলে লাভ হয় তাদের। কারন মাছ শিকারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি দক্ষ। তার ৫ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রিত টাকা সবই তুলে দেন তার হাতে। সে ৫ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে জানিয়েছেন।
আরো জানা গেছে, বরিশালের বানারীপাড়া মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মূলাদী, হিজলা, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের কালকিনি, উপকুলীয় জেলা পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে এ সম্প্রদায় কয়েক হাজার লোক নৌকায় বসবাস করছে। অবহেলিত মানতা পরিবারগুলো সকল মৌলিক ও নাগরিক সুবিধা পাওয়ার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবী জানিয়েছেন। সন্ধ্যা হলেই বানারীপাড়ার ফেরি ঘাটে এদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। ছোট ছোট থালা, গামলায় মাছের পসরা সাজিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে বসে থাকে ছেলে, মেয়ে স্ত্রী পুরুষ সবাই। সন্ধ্যায় মাছের প্রয়োজনে একমাত্র ভরসা এই মানতা সম্প্রদায়ের জেলেরা।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।