হাজি সেলিমের ১০ বছর সাজা বহাল রেখে রায় প্রকাশ ॥ ঝুঁকিতে এমপি পদ

‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগে দেড় যুগ আগের একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ১০ বছরের কারাদ- বহাল রেখে গত বছর দেওয়া রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে। ৬৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় দুটি ধারায় বিচারিক আদালতে ১০ বছর ও তিন বছরের কারাদ- হয়েছিল হাজি সেলিমের। এর মধ্যে একটি ধারায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদ- বহাল রেখে আরেকটি ধারায় তিন বছরের সাজা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
গত বছর ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। আদালতে হাজি সেলিম ও তাঁর স্ত্রীর আপিলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদার ও সাঈদ আহমেদ রাজা। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মনির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস।
রায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ লাখ টাকা অর্থদ-ও বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ টাকা পরিশোধ না করলে তাঁকে আরো এক বছর কারাভোগ করার কথা বলা হয়েছে রায়ে। তা ছাড়া এ মামলা সংক্রান্ত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে পুরান ঢাকার এই আওয়ামী লীগ নেতাকে বিশেষ জজ আদালত-৭ এ আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তাঁর জামিননামা বাতিল করে তাঁর বিরুদ্ধে যেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ফলে রায়ের নির্দেশনা অনুসারে, হাজি সেলিমকে জেলে যেতেই হচ্ছে।

রায় প্রকাশের পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, হাজি সেলিমের ১০ বছরের সাজার রায়াট প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ-দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো কঠোর হতে বলেছেন আদালত।
বলা হয়েছে, মিডিয়া কাভারেজ পেলেই চলবে না, কাজের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে দুদককে। তবে এই রায়ের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হচ্ছে, কমিশন এতে একটি দিকনির্দেশনা পেয়েছে। রায়ের এই পর্যবেক্ষণের আলোকে কমিশন কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। রায়ে বলা হয়েছে, কেউ সাংবিধানিক বা অসাংবিধানিক যে পদেই থাকুক না কেন, দুর্নীতি প্রশ্নে কারো ক্ষেত্রেই যেন তারতম্য করা না হয়।
আপিলের প্রক্রিয়া নিয়ে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘রায়ের নির্দেশনার আলোকে অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে তাঁকে জেলে যেতে হবে। জেল থেকে ওকালতনামা ও রায়ের অনুলিপি দিয়ে তিনি নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে পারবেন, জামিন চাইতে পারবেন। আদালত লিভ টু আপিল গ্রহণ করলে তিনি আপিল করতে পারবেন।
আত্মসমর্পণ ও আপিলের বিষয়ে হাজি সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অবশ্যই বিচারিক আদালতে আমরা আত্মসমর্পণ করব। একই সঙ্গে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল ফাইল করব। আমার মক্কেলের সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ ও আপিলের করার জন্য প্রস্তুত।
হাইকোর্টে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে দ-িত হাজি সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের আপিলটি বাতিল করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে দ-বিধির ১০৯ ধারায় গুলশান আরা বেগমকে তিন বছরের কারাদ- দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
হাইকোর্ট রায়ে বলা হয়েছে, বিচারিক আদালতে দ-িত হাজি মোহাম্মদ সেলিমের আপিল সংশোধন করে (আংশিক গ্রহণ ও আংশিক খারিজ) দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারা সংক্রান্ত আপিল গ্রহণ করা হলো। আর এই আইনের ২৭(১) এ আপিলের অংশ খারিজ করা হলো।
ফৌজদারি মামলায় এই দ-ের কারণে হাজি সেলিমের সংসদ সদস্যপদও এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইন প্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই কিংবা ততোধিক বছর কারাদ-ে দ-িত হলে সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবে না এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
হাজি সেলিমের সংসদ সদস্যপদ নিয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের ভাষ্য, ‘সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৈতিক স্খলনের কারণে হাজি সেলিম সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারেন না। হাজি সেলিমের সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা নাই। উনি আর সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না। এটা সাংবিধানিক বিধি-বিধান। আপিল বিচারাধীন এ কথা বলার সুযোগ নাই। আপিল বিভাগে গিয়ে যদি তিনি বেকসুর খালাস পান তবে তাঁর সংসদ সদস্য পদ পুনর্বহাল হবে। ফলে এ গত বছর ৯ মার্চ এ মামলার রায়ের দিন থেকে আইনগতভাবে ধরে নিতে হবে হাজি সেলিম সংসদ সদস্য না। তবে হাজি সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা মনে করেন, সর্বোচ্চ আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাজি সেলিমের সংসদ সদস্য পদ থাকবে।
তিনি বলেন, বিচারিক আদালতের কোনো একটি মামলা যখন আপিলে চলে যায় তখন সেটিকে চলমান মামলা হিসেবে ধরা হয়। ফলে সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাজি সেলিমের সংসদ সদস্য পদ থাকছে কি থাকছে না, তা বলা যাচ্ছে না। যেমন বিচারিক আদালতে একটা লোকের ফাঁসি হয়ে গেলেই তাকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া যায় না। হাইকোর্ট-আপিল বিভাগের আপিল নিষ্পত্তি করে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়। হাজি সেলিমের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিশেষ আদালতের রায়ে তাঁকে মোট ১৩ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়।
আর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে ‘সহযোগিতার’ দায়ে হাজি সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমকে দ-বিধির ১০৯ ধারায় তিন বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর হাজি সেলিম ও তাঁর স্ত্রী গুলশান আরা বেগম এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেন।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে দুদক। আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে হাজি সেলিমের আপিল পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সে নির্দেশনার আলোকে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুদক হাজি সেলিমের আপিল দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন করে। সেই আবেদনের শুনানি করে হাইকোর্ট ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন। নথি আসার পর গত ৩১ জানুয়ারি আপিলের শুনানি শুরুর পর গত বছরের ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিই প্রকাশ করা হলো। সুত্র : কালেরকণ্ঠ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।