ওবায়দুল হক বাবুল, সেই অম্লান মুখচ্ছবি
সময় কী দ্রুত চলে যায়! ভোলার কৃতী সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিব বাহিনীর মহকুমা-প্রধান ওবায়দুল হক বাবুল- হত্যার পর পঁচিশটি বছর চলে গেল ! কিন্তু আজও পর্যন্ত সেই নির্মম হত্যাকা-ের নেপথ্যে ঘাতকদর পরিচয় উদঘাটিত হলো না! যে চার ভাড়াটিয়া খুনি হত্যাকা- ঘটিয়ে ছিল, তাদেরকেও গুরুদ-ে দন্ডিত করা গেল না! কী বিস্ময়কর নির্মম বাস্তবতা।
১১ই অক্টোবর, ১৯৯৬। ঘুম ভাঙলো আমার স্ত্রীর কান্নার শব্দে। কান্নার কারণও ব্যাখ্যা করতে হয়নি। বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসি। দেখি বিছানার উপরই ডেইলি পত্রিকাগুলো। আমি তখন জনকণ্ঠে কাজ করি। পত্রিকার প্রথম পাতায় যে মর্মান্তিক হেডিং আর ছবি তা দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। ভোলা ১ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ওবায়দুল হক বাবুল ঢাকায় তার শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে সদর রাস্তায় অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত।
খবরের পাশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ব্লাডব্যাগ আর স্লাইনের সঙ্গে হৃদযন্ত্র পর্যবেক্ষণের নানা যন্ত্রপাতি কবলিত সৌম্যকান্ত চেহারার অমলিন সেই মুখচ্ছবি-যিনি আমার কৈশোর থেকে চেনা আমার স্বজন ওবায়দুল হক বাবুলের চির ঘুমন্ত মুখ। ডাক্তাররা তাকে বাঁচাবার সবরকম চেষ্টাই করেছিলেন কিন্তু হিংস্র ঘাতকের লক্ষ্যভেদী নৃশংস বুলেট তাকে চিরঘুমের দেশে নিয়ে গেছে। সেই গভীর নিমগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন আমার স্ত্রী। তার বোনের ছেলে “বাবুল মামা” নেই। ভোলার সকলের প্রিয় তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল হক বাবুলের এই অকাল অপঘাত মৃত্যু যে ছোট খালা-খালু হিসেবে আমাদেরকেই কিংবা শুধু নিকটাত্মীয়দের অশ্রুসিক্ত করেছে, তাই নয়, কাঁদিয়ে ছে ভোলা এবং ভোলার বাইরেরও বহু মানুষকে, যারা চিনতেন ওবায়দুল হক বাবুলকে। তিনি ছিলেন এমনই অমায়িক উদার আর সদা হাস্যজ্জ্বোল এক সজ্জন, যাকে দল-মত নির্বিশেষে হৃদয়বান মানুষমাত্রই ভালোবাসতেন।
সকাল আটটার মধ্যে আমরা পৌছে যাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ির কাছেই শহীদ বাবুলের বাসভবন লোকারণ্য। এসেছেন সর্বস্তরের মানুষ। সবাই মর্মাহত, স্বজন হারিয়ে স্তব্ধতায় নিমগ্ন। তার মত এমন একজন জনপ্রিয় নেতা এবং বিরল মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষকে কেউ খুন করতে পারে, এ কারও কল্পনাও ছিল না। অথচ সেই অপ্রত্যাশিত এবং অকল্পনীয় ঘটনাই ঘাতকচক্র ঘটিয়ে ছিল ১৯৯৬ সালের ১০ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর পল্লবীতে ,প্রকাশ্য গোধূলির আলোয়। দিনশেষে গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিরঘুমের দেশে হারিয়ে গেলেন।
১৯৬৬ সালে যখন ভোলায় এ রব হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ি, তখন থেকেই চিনতাম ওবায়দুল হক বাবুলকে। কারণ স্কাউট সদস্য হিসেবে, ভোলা সরকারি স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেন হিসাবে অতি অল্প বয়সেই তিনি সকলের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। তার চেয়ে ও বড় কথা, তিনি ভোলার এমন একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, যে পরিবারের সন্তান হিসেবে তার মত অসাধারণ মেধাবী তরুণ সহজেই সবার কাছে সুপরিচিত হয়ে ছিলেন। তদুপরি তাকে আরো ভালো করে চিনতাম ছাত্রলীগের তরুণ নেতা হিসেবে। উত্তাল পূর্বপাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়া মহান নেতা শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলনের ঢেউ ভোলায়ও ছড়িয়ে দেয়ার মত একজন সক্রিয় কর্মী তিনি। রাজনৈতিকভাবে ছাত্রলীগের আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে তখন থেকেই ভালোবাসতাম তাকে।
যা-ই-হোক ওবায়দুলহক বাবুলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ১৯৬৯ এর আন্দোলন মুখর দিনগুলিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র তিনি তখন। ভোলায়ও আসতেন, রাজনৈতিক কর্মসুচিতে অংশ নিতেন। মিছিলে যেতাম আলিনগর থেকে আমরা মাত্র দু-একজন, গ্রামের অন্য কয়েক ছাত্র করত এন এসএফ। মিছিলের কনিষ্ঠতম মুখ হিসেবে দৃষ্টিতে পড়ার মতো ছিলাম। কারণ আমার ছোটখাটো লিকলিকে গড়ন বয়সের চেয়ে ৫/৭ বছর পিছিয়ে রেখেছিল। তখন তাকে অন্যদের মতো আমিও বাবুল ভাই ডাকতাম। বয়সে সামান্য বড় হলেও তার ব্যক্তিত্ব তাকে যথার্থ যোগ্য নেতা করে তুলেছিল। বিয়ের পর থেকে ডাকতাম মামা। তিনি ডাকতেন কবি খালু। খুব পছন্দ করতেন আমাকে।
ভোলার যে ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি সে পরিবার ভোলায় শুধু প্রগতিশীল রাজনীতির স্থপতির গৌরবেই উজ্জ্বল নয়, ভোলার বনেদি ব্যবসায়ী বিত্তশালী পরিবার হিসেবেও মোল্লা-পরিবার ছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রে। পিতা জনাব সোলায়মান মোল্লা ছিলেন অসাধারণ সুদর্শন আর গুণবান কৃতি পুরুষ, ভোলাবাসীর প্রিয় নেতা। ভোলার আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভোলায় গণজোয়ার সৃষ্টিতেও তার ছিল উজ্জ্বল ভূমিকা। প্রবীণ ভোলাবাসীর কাছে তা অজ্ঞাত নয়। ভোলা পৌরসভার প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে ভোলা শহর উন্নয়নে রেখেছেন প্রশংসনীয় ভূমিকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠার দিনগুলিতে পঞ্চাশের দশকে সোলায়মান মোল্লা ছিলেন তার বন্ধু স্থানীয় সহচর। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অনেক জাতীয় নেতা আতিথ্য গ্রহণ করেছেন মোল্লা পরিবারে।
যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে ওবায়দুল হক বাবুল ছাত্র জীবনের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিয়ে যেমন জনপ্রিয়তায় অভিষিক্ত হয়ে ছেন, তেমনি মহান মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ভোলার তরুণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ও পরবর্তী কালের জাতীয় নেতা জনাব তোফায়ে ল আহমেদের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন ছাত্রনেতা হিসেবে জনাব বাবুল ভোলার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন পর্যন্ত এক কথায় বলতে গেলে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সংগ্রামী এই অকাল প্রয়াত নেতা নিজেকে সাফল্যে উদ্ভাসিত করেছেন। কিন্তু সে জীবনের এমন অকাল ইতিরেখা টেনে দেবে অপরাজনীতির কুটচক্র তথা হীন স্বার্থান্ধতায় চালিত ঘাতকের বুলেট, ভোলাবাসীর কাছে তা ছিল অকল্পনীয়।
তার মৃত্যুর পর প্রায় ২৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চললো, কিন্তু আজও তার হত্যার কারণ উদঘাটিত হলো না ! এ শুধু তার আত্মীয়-স্বজন বা ঘনিষ্ঠজনদের নয়, বিবেকবান প্রতিটি মানুষকেই মর্মাহত করেছে। ওবায়দুল হক বাবুলকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা ভোলায় সুস্থ রাজনীতির বিকাশকে হত্যা করেছে, যারা একটি বিশাল সম্ভাবনাময় জীবনের ইতি টেনে দিয়েছে, তারা হয়তো জানেনা যে, হত্যা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না, কিংবা মহত্ব যদি কেউ অর্জন করে ফেলেন, তাকেও মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।
যত স্বল্পপরিসরেরই হোক, কর্ম আর উদার মানবিক মহিমায় যারা জীবনকে মহিমাম-িত করে যান, তারা বেঁচে থাকেন সবার হৃদয়ে। সে কারণেই ঐরকম ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুঞ্জয়ী শব্দটি প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ মানুষের স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থেকে তারা মৃত্যুকেই মারেন। এই শেষোক্ত ধারার মানুষের পঙক্তিতে স্থান পাওয়ার মতো এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জীবন বিকশিত করেছিলেন ওবায়দুল হক বাবুল। কিন্তু জীবনের অফুরান সম্ভাবনায় মহীরুহ ব্যক্তিত্বে রূপান্তরের আগেই ঘাতকের তপ্ত বুলেট কেড়ে নিল তাঁকে।
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান যে হিংস্রতার দানবীয় অপসংস্কৃতি তারই নির্মম বলি হলেন তিনি। কেন তাকে এভাবে এত অকালে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হলো, কার বা কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এমন নির্মম পথ বেছে নিল পর্দার অন্তরালের হত্যাপরিকল্পক, তা উদঘাটন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কি অসম্ভব ? মনে হয় জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণই ছিল তার একমাত্র “অপরাধ” ! তার মত অসাধারণ জনপ্রিয় তরুণ নেতাকে হত্যার মধ্যদিয়ে এই অপ্রিয় সত্যটাই জানিয়ে দিয়ে গেল, রাজনীতি শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষদের বিচরণক্ষেত্র ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে, একালে আর নেই ! রাজনীতিতে এখন অস্ত্রবাজ খুনি, কালো টাকার অধিকারী ষড়যন্ত্রকারীদের আধিপত্য ! সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই দুর্ভাগা দেশে ওবায়দুল হক বাবুলের মতো গণমুখী ব্যতিক্রমী সৎ-আদর্শবান উদার ব্যক্তির রাজনীতিতে আসা একটা মস্ত বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলেই অনেকে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এই মন্তব্যও কি একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মেনে নেয়া সঙ্গত ? কেন অসুস্থ রাজনীতির পথ এমনই হবে যে, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা রাজনীতিতে আসতে পারবেন না ?
কেন আওয়ামীলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে সেই দলেরই একজন এমপি পদপ্রার্থীর হত্যাকা-ের প্রকৃতবিচার তারা করতে পারবেন না ? এরকম বিস্ময়কর অথচ অবাঞ্চিত বাস্তবতার মধ্যদিয়েই চলবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র ? ওবায়দুল হক বাবুলের মত এক শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তির অধিকারী নেতার নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারের পথে যদি এত বড় বাধা অদৃশ্য দেয়াল তুলবে, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী ? এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেশের জন্য তো বটেই, সুস্থ রাজনীতি চর্চার পথেও অশনিসংকেত ! ওবায়দুল হক বাবুলের হত্যাকারীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হতো, তা হলেও একটা সান্তাতনা থাকতো। খুনি যে-ই হোক, তার বিচার হবে, এটাই তো গণতান্ত্রিক সমাজের রীতি।
বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মামলাটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু সেই আমলেই চারখুনিকে নাকি লঘুদন্ড দেওয়া হয়ে ছিল, কিন্তু সব আসামি গ্রেফতারও হয়নি। পরবর্তীকালে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং নেপথ্যের দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা ছিল বৈ কী। কিন্তু ভোলার মানুষের সে আকাঙ্খা পূরণ হয়নি। ওবায়দুল হক বাবুর হত্যাকারীরা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। এই বেদনা অমোচনীয়।
নাসির আহমেদ
কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক
সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন
ও
উপদেষ্টা সম্পাদক
দৈনিক দেশের কন্ঠ।