বিএনপির ১১ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের হালচাল

ভাঙছে কমিটি, আসছে নতুন নেতৃত্ব

কাউন্সিলের ছয় মাস পর সোমবার জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২২ বছর পর ১২ মার্চ এর চতুর্থ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এক সপ্তাহ আগে ভেঙে দেওয়া হয় জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। যে কোনো সময় নতুন নেতৃত্ব পাবে জাসাস। শুধু এ দুটি সংগঠনই নয়, বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগেরই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্বে এগুলো ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, বিএনপির ধারাবাহিক বৈঠকে নেতারা এসব অঙ্গসংগঠনের নতুন নেতৃত্ব দাবি করেছেন। তারা এ-ও অভিযোগ করেন, তৃণমূলে কমিটি করতে গিয়ে বিএনপি নেতাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যসহ নানাভাবে অপমান-অপদস্থ করেছেন কোনো কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতারা। কমিটি গঠনে কোনো সুপারিশ পাত্তা না দেওয়ার অভিযোগও কিছু অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতার বিরুদ্ধে। তৃণমূলের যেখানেই কোনো অযোগ্য বা অনিয়মের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে, সেখানেই তারা হাইকমান্ডের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। কমিটি বাণিজ্য, যথাসময়ে কমিটি না দেওয়া, দলের সিনিয়র নেতাদের পাত্তা না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ডও।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘রাজনৈতিক দলে পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপির জেলা, উপজেলাসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে। দুই দিন আগে কৃষক দলের কমিটি দেওয়া হয়েছে। জাসাসের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যোগ্য নেতাদের নেতৃত্বে অঙ্গসংগঠনগুলো সাজানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, দুই দিন আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। এ ছাড়া মহিলা দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল- এসব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি দলের সিরিজ বৈঠকেও ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনের জন্য গঠিত টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। এ সময় মহিলা দলের নেতৃত্বে অতিমাত্রায় গ্রুপিং ও মারামারির কথাও উঠে এসেছে। এ নিয়ে বেশ বিব্রত দলের নীতিনির্ধারকরা। এ ছাড়া শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দলের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম নেই বলে সিরিজ বৈঠকে অভিযোগ করেন নেতারা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর কমিটির দুই বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে। নির্বাচিত কমিটিতেও সুফল পাননি বিএনপির হাইকমান্ড। বরং ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও বিভাগীয় টিমের কারও কারও বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগের পাহাড় জমে হাইকমান্ডের কাছে। সার্বিক বিবেচনায় ছাত্রদলেও নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসার চিন্তা করছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
আরো জানা যায়, ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির ক্ষেত্রে আহ্বায়ক পদের আলোচনায় আছেন ইকবাল হোসেন শ্যামল, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, আশরাফুল ফকির লিংকন, আমিনুর রহমান আমিন, শাহ নেওয়াজ ও মহিউদ্দিন রাজু।
অন্যদিকে সদস্যসচিবের আলোচনায় আছেন মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব, তানজিল হাসান, রিয়াদ ইকবাল, শ্যামল মালুম, মারুফ এলাহী রনি ও আক্তার হোসেন। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে বয়সের কারণে বাদ পড়তে পারেন ইকবাল হোসেন শ্যামল ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। বাকিদের মধ্যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বাছাই করা হতে পারে। তবে গত দুই বছরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শতাধিক ছাত্রনেতার পদহীন অবস্থায় বয়সের সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলে আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। এর মধ্যে মহিলা দল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা চুলোচুলি, মারামারি ও হাতাহাতি ঘটে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সমর্থকদের পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতেও দেখা যায়। সম্প্রতি অঙ্গসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বিএনপির হাইকমান্ড মহিলা দলের কর্মকান্ডে উষ্মা প্রকাশ করেন। পরোক্ষভাবে কমিটি ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়।
জানা যায়, মহিলা দলের নতুন নেতৃত্বের আলোচনায় আছেন- শিরীন সুলতানা, নিলোফার চৌধুরী মণি, রেহানা আক্তার রানু, সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরিন খান, বিলকিস ইসলাম, নায়াবা ইউসুফ প্রমুখ। জাতীয়তাবাদী যুবদলেও নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, যুবদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ করা হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরবকে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। যুবদলের নতুন নেতৃত্বের আলোচনায় আছেন- বর্তমান কমিটির সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মোরতাজুল কবীর বাদরু, নুরুল ইসলাম নয়ন, এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, মামুন হাসান ও মাহবুবুল হাসান ভূঁইয়া পিংকু।
এছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমীরুল ইসলাম খান আলিম, হাবিবুর রশীদ হাবিব, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, রাজীব আহসান ও আকরামুল হাসানের নামও নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আবার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি সেই নেতৃত্ব। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলেও আসছেন নতুন নেতৃত্ব। গত বছর করোনা আক্রান্ত হয়ে সংগঠনের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর মৃত্যুর পর নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ইয়াসিন আলী, ওবায়দুল হক নাসির, ফখরুল ইসলাম রবিনসহ বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে।
২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। সংগঠনটি এখন মেয়াদোত্তীর্ণ।
অধ্যাপক মামুন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খানের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি জাসাসের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নতুন কমিটিতে পদ পেতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী, এম এ মালেক, হেলাল খান, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, জাহাঙ্গীর শিকদার, জাকির হোসেন রোকন, রফিকুল ইসলাম রফিক, ইথুন বাবু প্রমুখ। এর বাইরে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরকে নিয়ে দলের একটি অংশ চিন্তা করছেন।
২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ মৎস্যজীবী দলের কমিটি ভেঙে সংগঠনের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আবদুর রহিমকে সদস্যসচিব করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিও নিষ্ক্রিয়। ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক ও মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্যসচিব করে ১৭১ সদস্যের ওলামা দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। শুধু মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সংগঠনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। ২০১৪ সালের এপ্রিলে শ্রমিক দলের কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিংয়ে সংগঠনটির হযবরল অবস্থা। এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং তাঁতী দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও কোনো তৎপরতা নেই। তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ ছাড়া বাকিরা নিষ্ক্রিয়। এরই মধ্যে এ সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার।

সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।