সর্বশেষঃ

ভোলায় মহিষ পালনে কৃষকের চোখে দিন বদলের স্বপ্ন

দ্বীপজেলা ভোলার অনন্য ঐতিহ্য ‘মহিষ পালন’। জেলায় প্রায় দু’শ বছর আগে থেকেই মহিষ বাতান আকারে পালন করে আসছেন কৃষকরা। বাতানে একই সঙ্গে দু’শ থেকে এক হাজার পর্যন্ত মহিষ পালন সম্ভব। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বসত বাড়ির গোয়ালঘরে পালন শুরু করেছেন। মহিষ পালনের ব্যাপকতায় এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠছেন। একদিকে মহিষ বিক্রি অন্যদিকে মহিষের দুধ বিক্রির টাকায় কৃষকরা দেখছেন দিন বদলের স্বপ্ন।
সরজমিনে জানা যায়, জেলায় শতাধিক বিচ্ছিন্ন চর রয়েছে। নদীর মাঝখানে এসব চরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এলাকা জুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ। আর এসব চরে পালন করা হয় হাজার হাজার মহিষ। সবুজ ঘাস খেয়ে পালিত হয় এসব মহিষ। যুগ যুগ ধরে বংশপরপ্রমাক্রমে বহু পরিবার এখানে মহিষ ও দধি বিক্রির পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। অনেকে আবার নিজস্ব মহিষের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন করে দধি তৈরি করেন। দধির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ নিয়ে বাতান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব বাতান থেকে মনে মনে দুধ আসতে শুরু করে শহরের বাজারগুলোতে। গ্রামাঞ্চলে হাটের দিনে দধির টালির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয় মহিষের দুধের দধি।


সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে ভোলার উৎপত্তি হলে এখানে ক্রমশই জনবসতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হলে তারা মহিষ, গরু, ছাগল পালন শুরু করে। ভোলা দ্বীপ হওয়াতে এখানকার ছোট বড় অসংখ্য চরে মহিষ পালনে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারগুলোর শত শত মহিষ পালন করে।
অনেকের ধারণা, প্রায় ২০০ বছর আগে স্থানীয়রা মহিষের দুধ থেকে কাঁচা দধি উৎপাদন শুরু করে। যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময়েও সমান জনপ্রিয়। এখানে এমন কোন বিয়ের অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দধি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়নি। এতেই বোঝা যায় এখানে এটা কত জনপ্রিয়।


মহিষ পালনে জীবন বদলে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে ভোলার চরের আব্দুল রশিদ (৫৫) বলেন, মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০১ সালে আমি চারটি মহিষ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এখন আমার ৩৬টি মহিষ। বর্তমানে আমার দুই একর জমি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। এ মহিষের দুধ বেঁচে আমি আমার সংসারের খরচ মেটাই। ভোলায় এখন মহিষ পালনে সবাই ঝুঁকছে। এতোদিন শুধু বাতানে পালন হলেও এখন তা বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশেও পালন হচ্ছে। মহিষ পালনে দিন বদলের এ গল্প ভোলা জেলার অনেক কৃষকের।


জানতে চাইলে মহিষের বাতান মালিক জাকির হাওলাদার বলেন, আমার ৯৫টি মহিষ আছে। এটা আমার দাদা পালন করেছে। তার পর চাচা পালন করেছে। এখন আমি করছি। তবে আগে মহিষ একটু কিছু না হতেই মরে যেত। তাই অনেকে বেশি পালন করতে চাইতো না। কিন্তু এখন কৃমি নাশক ওষুধ ও বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে মহিষ মরার হার অনেক কমে গেছে। একদিকে মরার ঝুঁকি কমেছে। অন্যদিকে মাংস ও দুধের দাম বাড়ার কারণে লাভের পরিমানও বেড়েছে। তাই অনেকের মতো আমারও বেশি মহিষ পালনের আগ্রহ বেড়েছে। আমি এ মহিষ পালন করে চারকানি জমি কিনেছি। যার স্থানীয় বর্তমান বাজার মূল্য ১০ লাখ টাকা।


মহিষের বাতানের মালিক মো. ইউনুছ বলেন, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরে তাদের বাথানে প্রায় আড়াই শত মহিষ রয়েছে। যা তারা চার পুরুষ ধরে লালন করে আসছেন। দৈনিক এখান থেকে ১৩০ থেকে ১৫০ কেজি দুধ হয়। জেলায় অনেকেই ঐতিহ্য ধারণ করে মহিষ পালন করে আসছেন। যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
স্থানিয় দধি বিক্রেতারা বলেন, সাধারণত দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের দধির (টালির) চাহিদা বেশি। বর্তমানে দেড় কেজি ওজনের দধি ১৫০ ও দুই কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দধি থেকে মাখন, ঘি ও ঘোল বানানো হয়। মাখনের কেজি ৮০০ ও ঘিয়ের কেজি বার শত টাকায় বিক্রি হয়। এর ভালো দাম পাওয়ায় তাদের লাভও ভালো হয়। তবে দুধের দাম বৃদ্ধি পেলে দধির দামও বাড়ে বলে জানান তিনি।


জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, বর্তমানে ভোলা জেলায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। সব গুলোই জলা মহিষ, এরা মাংস উপাদনের জন্য মহিষ পালন করে অথচ আমরা ইন্ডিয়াতে দেখেছি সেখানে তারা প্রত্যেকটি বাড়িতে নিজেরা গোয়ালঘর করে মহিষ পালন করতেছে। তাদের ৫৩% দুধ আসে মহিষের থেকে বাকি ৪৭% দুধ আসে গরু থেকে। হারিয়ানা, গুজরাট এই সমস্ত এলাকায় তারা উন্নত মুদ্রাজাতের ডেইরী মহিষ পালন করে, তাদের একটি মহিষ থেকে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। তারা মহিষ পালন করে দুধ উৎপাদনের জন্য। আমাদের মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য বাগেরহাট ও টাংগাইলে ২ টা মহিষ প্রজোনন খামার আছে। সেখান থেকে ভোলাতে আমরা ১৫০টির মত চেলা মহিষ বিতরন করেছি, এই চেলা মহিষ দিয়ে বাতানের মহিষগুলোকে কোড়াছ করে উন্নত জাতের মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য কাছ করছি যাহাতে প্রতিটি মহিষ প্রথম থেকেই ১০ থেকে ১৫ কেজি দুধ উৎপাদন করতে পারে।


তিনি আরো বলেন, আমরা ভোলা জেলায় খুব দ্রুত ১০০ একর জমির উপর ডি এল আরই ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রানালয়ের যৌথ উদ্দ্যেগে উন্নত মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য হারিয়ানা গুজরাট থেকে মহিষ আমদানি করে ভোলায় জেলা মহিষের বিস্তার কমিয়ে মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদন করবো। আমরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, আশা করি ভোলার মহিষের বাতান মালিকরা খুব শিগ্রই এর সুফল পাবে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।