সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৪৬ তম শাহাদাত বার্ষিকী স্মরণে
ইতিহাস অতীতের কথা বলে। ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে অকল্পনীয়, নিধারুন এক পৈচাশিক হত্যা যজ্ঞের শিকার হন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সমগ্র পরিবার। এই পৈচাশিক হত্যা যজ্ঞের শিকার হন বঙ্গবন্ধূ পরিবারের মোট ৩৭ জন সদস্য। এই দিনটি বাংলার মানুষের বেদনার দিন। বাংলার মানুষের চোখে অশ্রু বিন্দু রুপে বিষাদ সিন্দুর ঘটনার মতো চির বিরাজমান হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও ওদের ভয় কাটেনি বলে একে একে হত্যা করলো জাতির জনক এর সহধর্মীনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ, বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন শেখ কামাল, মেঝো ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ল্যাফটেনেন্ট শেখ জামাল তাদের সদ্য বিবাহিত সহধর্মীনি, সুলতানা কামাল, রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ট ভাই শেখ আবু নাসের-কে, অবশেষে বাকি থাকলো মাসুম কনিষ্ঠ সন্তান বাবা মায়ের আদরের শেখ রাসেল তাকেও ঘাতকরা রেহাই দেয় নাই। মৃত মায়ের কাছে নিয়ে নির্মম ভাবে পৈচাশিক ভাবে হত্যা করে শেখ রাসেলকে। ঘাতকরা জানতোনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা দেশে নাই। বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ীতে থাকতো জননেত্রী শেখ হাসিনার পরিবার। সেখানে গিয়েও তারা হামলা চালায় কিন্তু দেশে না থাকার কারণে আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকেন দেশের কল্যাণ ও নেতৃত্ব দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা।
বঙ্গবন্ধু পরিবার এর এই শোকগাথা যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে ততদিন চিরস্মরণীয় হয়ে অশ্রুজলে ভাসবে জাতি এই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জীবন অবসায়নে সাথে সাথে বাংলাদেশ আমাবস্যার এক গভীর আধারে নিমজ্জিত হয়ে ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে দেশে দেশে অনেক বরেন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন ইসলামের ইতিহাসে রাসুল (স:) এর মৃত্যুর পর ইসলামের চার খলিফা অন্যতম তিন জনকেই ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তার আগে রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করেছিল তার একান্ত আপনজন ব্রুটাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনসহ চার জন প্রেসিডেন্টকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পরিবার এর মতো এত বড় জঘন্য হত্যা যজ্ঞের শিকার হয় নাই কোন রাজনৈতিক পরিবার।
উপমহাদেশের বরেন্য নেতা মহাত্মাগান্ধীসহ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীসহ অনেকেই আততাহির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবন মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তাকে হত্যার পিছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা বা পুরো পরিবারকে নিচিন্ন করে ফেলা হঠ্যাৎ ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনা ছিল না। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের লিয়ামক শক্তি হিসাবে জাতির জনক এর পরিবার ও বঙ্গবন্ধু বলিষ্ট এক মাত্র ভূমিকার কারণে তাকে ইতিপূর্বে দুই দুইবার প্রহশনের বিচার এর মাধ্যমে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চেষ্টা চালিয়ে ছিল পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠি, কিন্তু বাংলার আপামর জনগণের প্রতিরোধ এর মুখে বারবারই পরাস্ত হতে হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠিকে। স্বাধীনতার চুড়ান্ত পর্বে যখন ফাঁসির দড়ি বঙ্গবন্ধুর গলায় পরাবার অপেক্ষায় তখন বিশ্ব জনমতের চাপেও পরাজিত পাকিস্তানি সৈনিকদের রক্ষা করার স্বার্থে জাতির জনককে মুক্তি দিতে বাধ্য হন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি।
ইতিপূর্বে ১৯৬৯ সালের ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির আই.এস.আই এজেন্টদেরকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য। এ খবর বঙ্গবন্ধুর জানতে পেরেছিলেন। (মার্কিন অবমুক্ত করা নথীতে উল্লেখ্য)।
মহান স্বাধীনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠির মদদপুস্ট হয়ে খুনি খন্দকার মোস্তাক সহ কিছু আওয়ামীলীগ দলীয় নেতাসহ সামরিক বাহিনীর লোক পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে তথাকথিত ভাবে যোগদান করা সামরিক কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র ছিল অন্যতম। প্রথম দিকে খন্দকার মোস্তাক, জিয়া, ফারুক, রশিদ এর সাথে বসে ছক আঁকেন কোলকাতা ও আগড়তলায় বসে। ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ ছিল বাংলার স্বাধীনতাকে ব্যার্থ করে দেয়া। প্রথম পর্বের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতার পর মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসায় নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু একই চক্রের। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে হত্যা করা বা ব্যর্থ করে দেয়া।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কতৃত্ব হাতে নেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে সামরিকি করণ করার জন্য ডধৎ ঈড়ঁহপরষ করার প্রস্তাব করেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার অন্যদিকে মূল্য উদ্দেশ্য ছিল শুধু সরকার পরিবর্তন করাই নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা। প্রমান স্বরুপ বলা যায় মোস্তাক, জিয়ার জাতীয় সংবিধান এর আনা পরিবর্তন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারে অগোচরে মেজর ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাশে যোগাযোগ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার জন্য। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই খুনি চক্রের আরো এক মেজর রশিদ-কে পাঠানো হয় মার্কিন দূতাবাশে সরকারের অগোচরে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান মার্কিন দূতাবাশে তাদেরকে পাঠান বলে সদ্য প্রকাশিত মার্কিন নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের ১৩ মে খুনি মেজর ফারুক, জেনারেল জিয়ার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাত এর জন্য মার্কিন সরকারের সহায়তা চান। এরঠিক ১৫ মাসের ব্যবধানে ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে বঙ্গন্ধুকে হত্যা করা হয়। ২০ শে মার্চ ১৯৭৫ সালে খুনি মেজর ফারুক তৎকালীন ডেপুটি চিপ অব র্স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে অভ্যুত্থানের সরাসরি নেতৃত্ব চান। হত্যাকান্ডের সাথে জিয়া জড়িত যদি নাই থাকেন তাহলে কেন তিনি এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে চেপে যান জিয়া। বঙ্গবন্ধু-কে হত্যার কালো রাতে ২৮টি ট্যাংক ১৮টি কামান, ও ৭০০ জন সেনা সদস্য নিয়ে অভিযান চালায়। উক্ত অভিযানে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি মন্ত্রী আঃ রব সেরনিয়াবাদ সহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন রাজনীতিক শেক ফজলুল হক মনি তার স্ত্রী সহ অনেককেই তারা হত্যা করে। ঐ পৈচাশিক রাত্রে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্ব মোট শিশু, মহিলাসহ ৩৭ জনকে হত্যা করে খুনিরা। মুলত: মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্ট ঘটনায় একজন অন্যতম কুশিলভ। ১৫ আগষ্ট এর পূর্বে খন্দকার মোস্তাক এর সাথে উক্ত খুনি চক্রের একাধিকবার মিটিং হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত খুনি চক্রের আদালতে জবানবন্দিতে উঠে আসে জেনারেল জিয়ার নাম।
প্রত্যক্ষ খুনিদের জিয়া বলেছেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও তাদেরকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাবেন তিনি। বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্ট এর রায়ে খুনি ফারুক, রশিদ, মহিউদ্দিন এর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। দ্বিতীয় ধাপে জেল খানায় অন্তরীন জাতির জনক এর চার রাজনৈতিক সহকর্মী, জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা। জিয়া ক্ষমতা দখল করে উক্ত খুনিদের বিদেশ বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরী ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করে দিয়ে ছিলেন। জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিন্ন করার লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর ১১৩০ জন সেনা ও কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। যাতে কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা না বলতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের পিছনে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ছিল। এই ষড়যন্ত্রের খুনিরা দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের শক্তি ছিল একতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। মোট কথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যারা খুশি হন নাই ১৫ আগষ্ট তাদেরই চক্রান্তের ফসল। এই চক্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনের ভিতরে। ছিচল্লিশ বছর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলেও আজকের এই হত্যাকান্ডের পিছনের কুশিলবদের তালিকা অনুসন্ধান এর চেষ্টা হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জড়িত উপসেনা প্রধান জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছুটা সর্তক হয়ে ছিলেন বলে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে বিদেশে রাষ্ট্রদুত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু দূতিয়ালিতে এই সিদ্ধান্ত বস্তবায়িত হয় নাই সেটিও এতদিনে প্রকাশ্যে আসা দরকার ছিল। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতেই বাংলার মানুষের আত্মার আর্তনাদ নারীর অশ্রুধারা থেমে যাবে না।
এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে ঘরের ভিতর ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রে। বাংলার জনগণের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ সারা দেশের মানুষের সর্বশেষ ভরসাস্থল। বাংলায় ঐতিহ্য বাংলার গণতন্ত্র, উন্নয়ন এর যে ধারা তিনি তৈরি করেছেন, তাকে অব্যাহত রখার স্বার্থে জাতিকে আরো বেশি সর্তক থাকতে হবে এই হউক আমাদের শপথ।
লেখক : ফজলুল কাদের মজনু
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামীলীগ।