বোরহানউদ্দিনে ২২ বছর পর হারানো ছেলে নূরনবীকে ফিরে পেয়ে আত্মহারা বাবা-মা

হারিয়ে যাওয়া ছেলে নূরনবীকে প্রায় ২২ বছর পর ফিরে পেয়ে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন বাবা কাসেম হালদার। এদিকে ৫ বছরের শিশু নূরনবী ২২ বছর পর নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসায় এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি নূরনবীর স্বজনদের মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা। এ সময় এক হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়।
নূরনবীর বাবা কাসেম হালদার জানান, প্রায় ২৭ বছর আগে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাগলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তার ছেলে নূরনবী। জম্মের ৭ দিন পরে মা পারুল পারিবারিক ঝামেলার কারণে নূরনবীকে রেখে অন্যত্র চলে যায়। এতে মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় নূরনবী। সে একপর্যায়ে দাদীর আদর যতœ ও ভালবাসায় বড় হতে থাকে। কিন্তু সেই আদর যতœও তার বেশিদিন টিকেনি। ৫ বছর বয়সে হঠাৎ একদিন দাদী তাকে পাটের শাক আনতে বলেন, কিন্তু তিনি পাটের শাক না এনে খেলতে যায়। সে সময় খেলতে গিয়ে হাতে ব্যথা পায় নূরনবী। এ কথা বাসায় এসে বললে দাদী তাকে উল্টো মারধর করেন। দাদীর এমন আচরণে মন খারাপ হয়ে যায় নূরনবীর। সে তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। বিকেলে বোরহানউদ্দিন খেয়াঘাট (লঞ্চঘাট) থেকে সে কোকো লঞ্চে উঠে। পরদিন সকালে ঢাকার সদরঘাটে এসে পৌঁছে। তখন নূরনবী বোরহানউদ্দিনের কোকো লঞ্চ ভেবে আবার ফিরে বহু লঞ্চের ভীড়ে ভুলবশত শরীয়তপুরের একটি লঞ্চে উঠে। পরে লঞ্চঘাটে ভিড়লে সে বুঝতে পারে যে ভুল লঞ্চে উঠেছিল। তখন লঞ্চেই কাঁদতে থাকে ৫ বছরের শিশু নূরনবী।
নূরনবীর বাবা কাসেম বলেন, সে সময় এক ভদ্রলোক নূরনবীর কান্না থামাতে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু নূরনবী পুরো ঠিকানা বলতে না পারায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ওই ভদ্রলোক অন্য এক ব্যক্তির কাছে নূরনবীকে হস্তান্তর করেন। সেখানে তিনি সে পরিবারের সাথে দীর্ঘ কয়েক বছর কৃষিকাজ করলেও তার কোনো ভিন্ন পরিচয় বা আর্থিক কোনো উন্নতি হয়নি। নিজের জন্য কিছু করতে পারেনি বলে মনে হলে ৭-৮ বছর আগে ফের ঢাকায় চলে আসে নূরনবী। এরই মধ্যে তিনি শরিয়তপুরের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। বর্তমানে নূরনবী দুই কন্যা সন্তানের জনক। ঢাকায় এসে নিজেই এক জায়গায় কথা বলে দর্জির কাজ শুরু করেন। কাজের সুবাদে ঢাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন নূরনবী। একপর্যায়ে তার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকেই জানতে পায়।
এদিকে, নূরনবী যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার বোনের এক ছেলে প্রবাসী থাকতেন। তিনি একদিন নূবনবীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের আর জে কিবরিয়ার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান “আপন ঠিকানায়” যেতে বলেন। তার কথা মতো নূরনবী “আপন ঠিকানা” অনুষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেন। এরপর তিনি স্টুডিওতে আসলে তার রেকর্ড শেষে বরাবরের মতো ভিডিওটি আর জে কিবরিয়ার ফেসবুক পেইজে শেয়ার করলে নূরনবীর এলাকার মিরাজ নামের এক যুবক কমেন্টে লিখেন উনি আমার এলাকার হতে পারে।


এমন কমেন্ট দেখে গাজীপুরের ব্যবসায়ী এবং বর্তমানে “স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেড” এর স্বেচ্ছাসেবী আবদুল জলিল সেই মিরাজের সাথে যোগাযোগ করে নূরনবীর পরিবারের খোঁজ নেওয়ার অনুরোধ জানান। স্বেচ্ছাসেবী জলিলের কথামতো তিনি কাজ করতে শুরু করেন। হারিয়ে যাওয়া ছেলের সন্ধান পেয়ে নূরনবীর বাবা কাসেম হাওলাদার চলমান লকডাউনের মধ্যেও ঢাকায় আর জে কিবরিয়া’র সেই স্টুডিওতে হাজির হন। সেখানে প্রায় ২২ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলের সাথে বাবার মিলন হয়। ছেলেকে নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন বাবা কাসেম হালদার।
কাসেম হালদার বলেন, ছেলে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি ছেলেকে প্রায় ১০ বছর ধরে পাগলের মতো খুঁজেছি। ছেলেকে খুঁজতে ঢাকা গেছি বহুবার। ঢাকার মোহাম্মদপুর, মূরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বহু জায়গায় বহু টাকা খরচ করে খোঁজাখুঁজির পরেও ছেলেকে আর পাইনি। তিনি আরও বলেন, ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলাম।
এ ব্যাপারে নুরনবীর সাথে কথা হলে নূরনবী সংবাদকর্মীদের জানান, নুরনবীর বয়স যখন ৬ বছর তখন সে তার দাদির সাথে রাগ করে বোরহানউদ্দিন খেয়াঘাট থেকে লঞ্চে উঠলে লঞ্চ যোগে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকা থেকে ভুলক্রমে শরীয়তপুরের লঞ্চে উঠে শরীয়তপুর চলে যায়। শরীয়তপুর যাওয়ার পরে সে যখন কান্নাকাটি করে তখন এক লোক তাকে আশ্রয় দেয়। বোরহানউদ্দিন থেকে যাওয়ার পরে শরীয়তপুরের সফিপুর থানার বালা বাজার ইউনিয়নের সেলিম মাঝির কাছে বড় হন নুরনবী। সেখান থেকে ১৬ বছর বয়সে ঢাকায় এসে কেরানীগঞ্জ থেকে দর্জির কাজ শিখে নুরনবী।
গত দেড় মাস আগে আরজে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ নামক অনুষ্ঠানে বিস্তারিত তুলে ধরেন নুরনবী, দেড় মাস পর গত শুক্রবার আরজে কিবরিয়ার মাধ্যমে নূরনবী ফিরে পান তার বাবা এবং মা কে। নূরনবী তার বাবা মাকে ফিরে পেয়ে বলেন, আমার এখন একটা পরিচয় হয়েছে। হয়েছে ঠিকানা। এতদিন আমি আমার বাবা-মার নাম জানতাম না। এখন আমি আমার বাবা-মার নাম জানি, আমার এখন পরিচয় আছে।
এ ব্যাপারে নুরনবীর স্ত্রী শারমিন বেগমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নূরনবী ভোলা থেকে যাওয়ার পর আমার ফুফুর কাছে বড় হয়েছেন। সেই সুবাদে আমাদের দুজনের সাথে একটা রিলেশনশীপ গড়ে ওঠে। আমরা দুজন দুজনকে বিয়ে করে ফেলি। আমাদের ঘরে দুটো সন্তান রয়েছে, দুটোই মেয়ে। ১ম মেয়ের বয়স ৪ বছর ৪ মাস। আরেকজনের বয়স ১ মাস। আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে ফিরে পেয়ে খুব আনন্দ অনুভব করছি।
এ ব্যাপারে নুর নবীর মায়ের সাথে কথা হলে নুরনবীর মা সংবাদকর্মীদের জানান, আমার ছেলে হারিয়ে গেছে। ছেলের জন্য আমি অনেকের কাছে গিয়েছি, অনেক টাকা নষ্ট করেছি। আমার এই বুকের মানিককে আমি ফিরে পেয়েছি। আমার তিন ছেলের মধ্যে নুরনবী বড়। আমার সন্তানকে হারানোর পর আবার ফিরে পেয়েছি, এখন আমার কাছে অনেক ভালো লাগে।
এ ব্যাপারে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোঃ হুমায়ুন গোলদার বলেন, আমার এলাকার হালদার বাড়ির রিকশা চালক কাসেম হালদারের ছেলে নূরনবী ৫-৬ বছর বয়সে তার দাদির সাথে রাগ করে বাড়ি পালিয়ে যায়। কোকো লঞ্চে উঠে ঢাকা গিয়ে হারিয়ে যায়। নূরনবী হারিয়ে যাওয়ার পর তার বাবা কাসেম বহু টাকা খরচ করে পাগলের মতো খুঁজেছে। পরে কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলের খোঁজ পেয়ে ছেলেকে নিয়ে এলাকায় আসে কাসেম। তিনি আরও বলেন, কাসেমের হারিয়ে যাওয়া ছেলে খুঁজে পাওয়ায় আমরাও আনন্দিত।
আর জে কিবরিয়া বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্য আমার ফেসবুক পেইজে “আপন ঠিকানা” যারা হারিয়ে যায় তাদের ভিডিও ধারণ করে প্রচারের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরে পেতে সাহায্য করে। ঠিক সেভাবেই ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার রিকশা চালক কাসেম তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে নূরনবীকে ২২ বছর পর ফিরে পেয়েছে।
খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে কুতুবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জোবায়েদ মিয়া বলেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাগলা গ্রামের কাসেম হালদার তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে নুরনবী, তার স্ত্রী ও তাদের ২ মেয়েকে নিয়ে শুক্রবার এলাকায় এসেছে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।