ভোলায় ভালো নেই, অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা

উপকূলীয় জেলা ভোলা সদর উপজেলার নাজিউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দীর্ঘদিম চাকুরী করার পর এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন এম ফারুকুর রহমান। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা অধিকাংশ মানুষের কাছে তিনি ফারুক স্যার নামেই পরিচিত। দীর্ঘদিন যাবত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করায় তাকে অনেকে আবার ফারুক সাংবাদিক নামেও চেনেন। এম ফারুকুর রহমান একাধারে একজন শিক্ষক, একজন সাংবাদিক ও একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি এলাকায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গুনি ব্যক্তিও বটে।

শহরের কালিবাড়ি রোডের ছোট্ট অথচ পরিপাটি ও সাজানো-গোছানো একটি বাসায় বসবাস করছেন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল নাজিউর রহমান ডিগ্রী কলেজ থেকে অবসর নেন এম ফারুকুর রহমান। ১৯৮৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেছিলেন। চাকরি করেছিলেন ভোলা ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজেও। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন।
নাজিউর রহমান ডিগ্রী কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর তাকে দেওয়া হয় কল্যান তহবিলের মাত্র ৮ লাখ টাকা। যা দিয়ে বর্তমান বাজারে একজন শিক্ষকের সারাজীবন চলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক। এম ফারুকুর রহমান বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরের পর সরকারি চাকরিজীবিদের মতো কোন পেনশন নেই। তাই করোনাকালীন সময়ে খুব দুরাবস্থার মধ্যে দিন কাটছে অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের। তারা এখন ধার দেনা দিয়ে চলছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন সেই সব অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা। তিনি বলেন, আমার ৩ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে ১ ছেলে জাপানে বসবাস করছে। সেখানে একটি ভালো চাকরিও করে। ছেলের পাঠানো টাকা দিয়েই চলছে আমার ছোট সংসার।
সাবেক অধ্যক্ষ এম. ফারুকুর রহমান বলেন, যে শিক্ষকরা তাদের জীবনের স্বর্ণযুগে শুধু শিক্ষাদান করে গেছেন। অবসরে গিয়ে তাদের ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এটা অমানবিক। তিনি আরও বলেন, আমাদের সময়ে যে সব বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে গেছেন তারা এখনকার শিক্ষকদের মতো এতো সুবিধা ছিল না। তাই বিগত ১০-১২ বছর আগে যে সব বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের সংসার খুব কষ্টে চলছে।
যে সব অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের ছেলে বিদেশে বসবাস করেন না এবং ভালো চাকরিও করছেন না সেসব অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা করোনাকালীন সময়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা অন্যের কাছে সাহায্যও চাইতে পারছেন না। করোনাকালীন সময়ে অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন প্রনোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এম ফারুকুর রহমান। তিনি বলেন, অধিকাংশ অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরের পর যে টাকা পেয়েছেন সে টাকা অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছেন। এখন তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ধার দেনা করে অনেক কষ্টে তাদের সংসার চলছে।
গত ৩ বছরেও অনেক অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক তাদের রেখে যাওয়া কল্যান তহবিলের টাকা ও অবসরভাতাও পাননি। করোনাকালীন এ দুর্যোগে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের অমানবিক জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার নলিনী দাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে চাকরি করার পর ২০১৮ সালে অবসরে যাওয়া ইয়াছিন বলেন, অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর কল্যান তহবিলের কিছু টাকা পেলেও সেই টাকা বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও অবসর ভাতা পাইনি। ইয়াছিন বলেন, একমাত্র ছেলে একটি ইন্সুরেন্সে চাকরি করে। ছেলেও বিয়ে করে নিজে সংসার করছে। একমাত্র মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছি। করোনাকালীন এ সময়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে খুব কষ্টে আছি।
এ ব্যাপারে নলিনী দাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অসীম সাহা বলেন, ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক ইয়াছিন অবসরে যাওয়ার পর তিনি কল্যান তহবিল থেকে ৬ লাখ টাকার মতো পেয়েছেন। কিন্তু অবসর ভাতা এখনো পাননি। অসীম সাহা বলেন, অবসর ভাতা পেতে সময় লাগবে।
৫ মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র মজুমদার। তিনি নলিনী দাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খন্ডকালীন চাকরি করার পর অবসরে যান অনেক বছর আগে। এরপর অর্থনৈতিক সংকটের কারনে ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করছেন প্রায় ১৮ বছর ধরে। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে তার সংসারের খরচ চলছিল। কিন্তু মহামারী করোনা আসার পর থেকে সেই স্কুল থেকে আয় করা টাকাও বন্ধ হয়ে যায়। প্রভাত চন্দ্র মজুমদার বলেন, আমি এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমস্যায় রয়েছি। আমার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় এখনো ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু তারা আর কতদিন এভাবে সহযোগিতা করবে? করোনা ও লকডাউনের কারনে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক সংকটে পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি এ শিক্ষক।
এ ব্যাপারে ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারনে প্রভাত চন্দ্র মজুমদার স্কুলের কয়েকজন হিন্দু ছাত্রীকে পড়াতেন। বিনিময়ে ছাত্রীরা মাসে কিছু টাকা দিতো। তা দিয়ে কোনরকমে প্রভাত চন্দ্র মজুমদারের সংসারের খরচ চলছিল। কিন্তু করোনার কারনে এখন তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এর আগে আমি ও বিত্তবান কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিছু সহযোগিতাও করেছিলাম।
ভোলা জেলায় কতজন বেসরকারি শিক্ষক অবসরে আছেন তার কোন সঠিক তথ্য দিতে পারেন নি জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মাদব কুমার দাস। তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর তার কোন তথ্য অফিসে থাকেনা। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন মন্তব্যও করতে রাজি নন এ শিক্ষা অফিসার।
ভোলা জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র থেকে জানা গেছে, এ জেলায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৩০টি। শিক্ষক রয়েছেন ৮ হাজার ৭২০ জন। গত ৫ বছরের হিসেবে অবসরে গেছেন এক হাজার ৮শ জন শিক্ষক ও কর্মচারি। এর মধ্যে আর্থিক অভাব অনটনে রয়েছেন কমপক্ষে এক হাজার শিক্ষক ও কর্মচারি।
করোনাকালীন সময়ে অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের প্রনোদনা দেওয়ার দাবিতে ভোলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা।

ভোলা সদর উপজেলার পৌর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক গোলাম মাহামুদ, ঘুইংগার হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুল অদুদ, গাজীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম, চরনোয়াবাদ মুসলিম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু তাহের, দৌলতখান খাদিজা খানম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ফরমুজল হক, চরফ্যাশন টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সহিদ ও চরফ্যাশন কেরামতগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ জানান, অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা করোনাকালীন সময়ে কষ্টে দিন যাপন করছেন।
সাবেক ভোলা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোকাম্মেল হক বলেন, ১০-১২ বছর আগে যে সব বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা বর্তমান বেসরকারি শিক্ষকদের মতো এতোটা সুবিধা পাননি। তাই ওই সময়ের অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বর্তমান বাজারের সাথে তালমিলিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই করোনাকালীন সময়ে তাদের জন্য সরকারের কাছে এককালীন প্রনোদনার দাবি যুক্তিসঙ্গত। তাদের সেই দাবির সাথে একমত পোষন করেন সাবেক এ শিক্ষা অফিসার।
এ ব্যাপারে ভোলা জেলা বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও টবগি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ শাহ নেওয়াজ বলেন, এক সময় দেশ গড়ার কারিগর যে বেসরকারি শিক্ষকরা আজ অবসর জীবন যাপন করছেন তারা আজ চরমভাবে অবহেলিত। তিনি আরও বলেন, আত্মমর্যাদা বোধ মনে করে তাদের দুঃখের কথা কারোর কাছেই বলতে পারছেন না। আবার সইতেও পারছেন না। বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।