সর্বশেষঃ

স্বাধীনতা মুক্তি ও উন্নয়নের গৌরবজ্জল প্রতিষ্ঠার ৭২ বছর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ

বাঙালী জাতীয়তাবাদ, অসম্প্রদায়িক রাজনীতি, গণতন্ত্র ও সমাজ প্রগতির মুলমন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৪৯ সনের ২৩ শে জুন আওয়ামীলীগ এর প্রতিষ্ঠা। আজ প্রতিষ্ঠার ৭২ বছর। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতার অর্ধশতাব্দির অধিক পুরাতন এই দলটির রয়েছে বীরত্বপূর্ন সংগ্রামের এক গৌরবউজ্জল ইতিহাস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিচল ধারাবাহিক নেতৃত্ব, আওয়ামীলীগ তার প্রতিষ্ঠারলগ্ন থেকে বাঙালী জাতির অধিকার, গণতন্ত্র, মাতৃভূমির স্বাধীনতা জনগরে মুক্তি ও উন্নয়ন কল্যাণে বলিষ্ট ভূমিকা ও আত্মত্যাগ করে গেছেন।
ভারতবর্ষের অনেক আঞ্চলিক ভাষাবাশী অঞ্চল রয়েছে কিন্তু বাঙালী ছাড়া কোন জাতিই ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনা বোধ তৈরি হয় নাই এই অঞ্চলে। ১৯৪৭ এর দেশভাগ হয়েছিল ধর্মীয় আবরনের ভিত্তিতে। বৃটিশ আমলে ১৯০৫ সালে বাংলাকে ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত করার জন্য ভঙ্গভঙ্গ আইন তৈরি করে সমগ্র বাংলাকেই দুইভাগে বিভক্ত করার চক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার আপামর জনতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব আন্দোলনের ফলে ১৯১৫ সালে ভঙ্গভঙ্গ রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ১৯০৬ সালে ভারতীয় মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের রাজনীতি ধমীয় আবরনে বিভক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে বাঙালী কৃষক প্রজা সাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাংখ্যা, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এর উত্থাপিত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের সুপারিশ করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় দেশ বিভাগের প্রাক্কালে, আবুল হাসেম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরন শংকর রায়, সোহরাওয়ার্দীর অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ধারাটির একমাত্র সফল নায়ক এবং সংগঠনগত ভাবে আওয়ামীলীগ এক মাত্র স্বার্থক প্রতিনিধি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথমেই হোচট খায় রাষ্ট্রটি বাঙালীর রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে। বলা বাহুল্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালীর সার্বিক মুক্তি, স্বাতন্ত্র আত্ম পরিচয়ের জাতীস্বতার প্রশ্ন কোনটিই মিমাংসা করতে পারে নাই।  এমনি এক প্রেক্ষাপটেও রাজনৈতিক পটভূমিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ০৪ মাস ২০ দিনের মধ্যে ১৯৪৮ সনের ৪ জানুয়ারি মুসলিম লীগ সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হয়, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। এই ছাত্র সংগঠন এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন আওয়ামী মুসলীমলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হন, তরুন নেতা শেখ মুজিব এর উদ্যোগে।
কে.এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান এর তৈরি করা মুসলীম লীগ এর কর্মী বাহিনীর প্রগতিশীল বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতারা মাওলানা ভাষানীকে সভাপতি, টাংগাইলের সামসুল হক-কে সাধারণ সম্পাদক, জেলে বন্দিথাকা অবস্থায় শেখ মুজিবকে অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী মুসলীমলীগ নামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। (বিঃ দ্রঃ তৎকালীন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, সামাজিক কৌশলগত কারনে মুসলীম শব্দটি ব্যাবহার করতে হয়েছিল।)

পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অনুকুল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য দলের দ্বার উন্মুক্ত করনের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার রুপমহলে দলের কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করার মধ্যে দিয়ে দলের নামের সাথে মুসলীম শব্দটি বাদ প্রদান করে দলকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিনত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব এর বলিষ্ট সাংগঠনিক নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ বাঙালী স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসাবে গড়ে উঠে।
একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য যে, এই দলটি কখনোই পাকিস্তান ভিত্তিক দল হিসাবে গড়ে তোলা হয় নাই। মুলত: পূর্ব বাংলা ভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী দল হিসাবে এর স্বকীয়তা বজায় রাখা হয়েছে। বাঙালির স্বার্থ নিয়েই বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে এই দলটি তার প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই লড়াই করে গেছে। উদাহরন হিসাবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি পূর্ন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন। এক মাথা এক ভোট ভিত্তিক সংসদীয় গণতন্ত্র, সংবিধান প্রনয়ন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দুরকরণ ও শোষণ মুক্তি প্রশ্নে দীর্ঘ সংগ্রামে অবর্তীণ হয়। বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ ও ছাত্রদের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতায় ও পারিচালনার ফলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাঙালীদের মধ্যে প্রথম ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলন গড়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে জেলে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। এর বহি:প্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতায় জয় লাভ করে। পাকিস্তানি পাঞ্জাবী শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, জেল জুলুম নির্যাতনে বাঙালীর ত্রাণকর্তা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ৬ দফা দাবীপেশ এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী শাসন পর্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদের  দ্রুত বিকাশ ও বিস্থিতি ঘটে। ১৯৬৬ সালের দেশবাশীর সম্মূখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার মর্মকথা ছিল, বাঙালীর স্বাধীনতা। যার প্রেক্ষিতে আতংকগ্রস্থ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে চিহ্নিত হয়। এই মামলাকে কেন্দ্র করে দেশে বিস্ফোরনমুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যার প্রেক্ষিতে ছাত্র ও গণআন্দোলনের মধ্য প্রেসিডেন্ট আইউব খান এর পতন শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি লাভ করে। এই ৬ দফাদাবী শেখ মুজিবকে বাংলার অভিসম্ভাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। শেখ মুজিব জনতার মহাসমাবেশ বঙ্গবন্ধু হিসাবে অভিশিক্ত হলেন। সামরিক আইন জারি করে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ, জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ একক রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন পেয়ে নিরংকুশ ভাবে বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগ এর এই বিজয় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠিরকে হতবাক করে দেয়। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নাই এই বিজয়কে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমশির কারণে সমগ্র পূর্ব বাংলায় এক বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার দাবী সোচ্চার হয়ে উঠে। ৭ই মার্চ ১৯৭১ রমনা রেসকোর্স ময়দানের মহা সমাবেশে দাড়িয়ে তার ঐতিহাসিক বক্তিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জেবিত করলেন জনতাকে। বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদিয়ে প্রস্তুত হলো। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নির¯্র জনতার উপর ঝাপিয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে নিরস্ত্র জনতা হয়ে উঠলো সশস্ত্র যোদ্ধা হিসাবে। অবশেষে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ৯ মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো বাংলার স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ এর প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় অর্জন হিসাবে চিহ্নিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতা ও হানাদার মুক্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফিরে আসা এবং প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ। যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশের পুন:গঠন এর তরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সাফল্য এক ঐতিহাসিক মাইল ফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এক কথায় বলা চলে বঙ্গবন্ধু হিমালয় পর্বত সমান রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করে রেখে গেছেন।
১৯৭৫ স্বাধীনতার শত্রু দেশীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলে বাংলাদেশে পাকিস্তানী এজেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক শাসন ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়। স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে নির্বাশিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের বেঁচে থাকা দুই কন্রা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরে আসতে বাধাগ্রস্ত করা হয়।
এমনি এক পরিস্থীতিতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জাতির জনক এর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি ইডেনহোটেল চত্বরে আওয়ামীলীগ এর ত্রয়োদশ কাউন্সিলে সর্ব সম্মতভাবে আওয়ামীলীগ এর সভাপতি নির্বাচন করে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ই মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দলের দায়িত্বভার নিজ হাতে তুলে নেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এর মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ নতুন প্রাণ শক্তি ফিরে পান। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা উজ্জিবিত হয়ে উঠেন। শুরু হয় নতুন অভিযাত্রা। অবশেষে অনেক লড়াই সংগ্রাম এর পথ বেয়ে আওয়ামীলীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে। জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার দেশকে হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনায় ফিরিয়ে এনে, সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির এক ভীত তৈরি করেন। বার বার ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের ফলে আঘাত প্রাপ্ত হয়েও আওয়ামীলীগ তৃণমূলের বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে ঘুড়ে দাড়িছে দেশের জনগনকে নিয়। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক সমৃদ্ধ জনপথে পরিনত হয়েছে। বিশ্ব দরবারে সম্মান সমৃদ্ধি নিয়ে মাথা তুলে দাড়িয়েছে।
আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন লালন করে আসছেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে স্বপ্ন পূরণ করে উন্নত সমৃদ্ধ জীবন গড়ার যে সংগ্রাম তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামীলীগ ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এই হউক আমাদের দৃঢ় অঙ্গিকার।
লেখক : ফজলুল কাদের মজনু
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।