ভোলায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ-গুলি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত ॥ নিহত-১ ॥ আহত অর্ধ-শতাধিক ॥ আটক-১

মনপুরায় হাজীরহাটে আ’লীগের বিদ্রোহী ও দক্ষিণ সাকুচিয়ায় আ’লীগের প্রার্থী জয়ী


তজুমদ্দিনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট বর্জন ॥ পুনরায় ভোট দাবী ॥ ৩ এজেন্টের কারাদন্ড


ভোলার বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনা আর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের ১২ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ৮টায় নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়। যতই সময় যেতে থাকে ততই প্রার্থীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। কিছু কিছু ভোট কেন্দ্রে ভোটাররা উৎসাহ আর উদ্দিপনা নিয়ে বৈরী আবহওয়া উপেক্ষা করে তাদের পছন্দের প্রর্থীকে ভোট প্রদান করেন।
অন্যদিকে নির্বাচনের আগের দিন গত সোমবার সকালে চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ থানার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ১৯৫ নং চরফকিরা কো-ইড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পুলিশ ১২ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। ত্রি-পক্ষের সংঘর্ষ আর গুলি বিনিময়ের ঘটনায় মনির হোসেন (২৩) নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। বিস্তারিত জানুন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে-
আমাদের চরফ্যাশন প্রতিনিধি জানান, চরফ্যাশন উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১ জন নিহত ও পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন। সোমবার দুপুরে উপজেলার শশীভূষণ থানার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ১৯৫ নং চরফকিরা কো-ইড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত ৬ জনকে চরফ্যাশন হাসপাতালে ভর্তি করলেও বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নিহত ওই ব্যক্তি ৫ নং ওয়ার্ডের বশির মিস্থির ছেলে মনির হোসেন (২৩)। চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শোভন বাশাক একজনের মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন। উভয় পক্ষের গুরতর আহতরা হলেন, সহিজল ইসলামের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫), তাসলিমা (৩০), লিজা (৪), ইমন (৩০), নুরনাহার (২৮), সুলতানা (৪০), রুনু বেগম কহিনুর (৪০), জান্নাত (৩০), ছায়েরা (৬০) সহ ১২ জনের খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেম্বার প্রার্থী ইউসুফ সিকদারের ছেলে রিয়াজ সিকদারকে আটক করেছে।
স্থানিয় সুত্রে জানা গেছে, ইউপি সদস্য প্রার্থী ইয়াছিন মাঝি (ফুটবল) ও ইউসুফ শিকদারের (টিউবওয়েল) সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এ সময় খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হন মনির। তাঁকে চরফ্যাশন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে কিছুক্ষণ পর সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।


নিহত মনিরের স্বজন আহত আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী জুলেখা বেগম জানান, তারা ভোট দিতে গেলে সংঘর্ষের সময় কেন্দ্রের ভেতর থেকে কে বা কারা গুলি মেরেছে তা বুঝে উঠতে পারেনি। তবে ইউছুফ সিকদারের লোকেরা এটা করতে পারে বলে তাদের সন্দেহ।
ইউছুফ সিকদারের কর্মী ও ৫ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি আবু জাহের ও অপর মহিলা কর্মী রিংকু জানান, রুহুল আমিন মিঝি (সিলিং ফ্যান) মার্কা ও ইয়াছিন মাঝির (ফুটবল) মার্কার লোকজন একত্র হয়ে কেন্দ্রে হামলা করে। কেন্দ্র রক্ষার্থে পুলিশ ছোরা গুলি করে। এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই এলাকায় বিজিবি মোতায়েন অবস্থা রয়েছে।
প্রিজাইডিং অফিসার ইমাম হোসেন জানান, উভয় পক্ষ সংঘর্ষ করে কেন্দ্র দখল করতে চাইলে পুলিশ গুলি ছুরে। শশীভুষণ থানা অফিসার ইনচার্জ ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের পুলিশ গুলি করেনি। কে করেছে তা খতিয়ে দেখা হবে।
উপজলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রুহুল আমিন বলেন, ঘটনা শুনেছি তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নিব। নিহতের পরিবার মামলা করতে আইনগত সহতায় পাবে।
ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১২ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। পুলিশের গুলিতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
অন্যদিকে চরফ্যাশন উপজেলার হাজারিগঞ্জে সেলিম উদ্দিন, চর মন্তাজে আব্দুল হাই, চর কলমিতে কাওসার হোসেন, এওয়াজপুরে মাহাবুব আলম, জাহানপুরে নাজিম হোসেন হাওলাদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন।
আমাদের বোরহানউদ্দিন প্রতিনিধি জানান, বোরহানউদ্দিন উপজেলার গংগাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মোঃ রেজাউল করিম রিয়াজ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে সাচড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মনোনয়নকৃত (নৌকা) প্রতীক প্রার্থী মোঃ মহিবুল্লাহ মৃধা ৭১৯০ ভোট পেয়ে পুনরায় চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ােঃ মাকসুদুর রহমান (হাতপাখা) প্রতীকে ৯০৪ ভোট পেয়ে ২য় অবস্থানে রয়েছেন।
আমাদের মনপুরা প্রতিনিধি জানান, মনপুরা উপজেলায় ২টি ইউনিয়নে নির্বাচনে একটিতে আ’লীগের বিদ্রোহী ও অপরটিতে আ’লীগের প্রার্থীর বিজয়। এতে হাজীরহাট ইউনিয়নে আ’লীগের প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) শাহরিয়ার চৌধুরী দীপককে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (আনারস প্রতীক) মোঃ নিজাম উদ্দিন। তবে দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নে জয়ী হয়েছেন আ’লীগের প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) অলি উল্লা কাজল। সোমবার ভোট শেষে রাত ৯ টায় ফলাফল ঘোষণা করেন উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার পাল।
নির্বাচনের ফলাফলে হাজীরহাট ইউনিয়নে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন ৭৩০২ ভোট। অপরদিকে আ’লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ৫৩৯২ ভোট। অন্যদিকে দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নে আ’লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ৮০৮২ ভোট। তবে ওই ইউনিয়নে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রফিকুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারলেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই) এর প্রার্থী পেয়েছেন ৩১৩ ভোট।
আমাদের তজুমদ্দিন স্টাফ রিপোর্টার জানান, ভোলার তজুমদ্দিনে ৩টি ইউনিয়ন নির্বাচনে অনাকাঙ্খিতভাবে পৃথক পৃথক দু’একটি সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠভাবেই ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তজুমদ্দিনের চাঁচড়ায় আবু তাহের (নৌকা) ৫৬২৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী রিয়াদ হোসেন হান্নান (আনারস) পেয়েছেন ১৪৬৫ ভোট। যদিও তিনি দুপুরের দিকে ভোট বর্জন করে পুনরায় ভোট নেয়ার দাবী জানিয়েছেন।
এছাড়া চাঁদপুর ইউনিয়নে একেএম শহিদুল্যাহ কিরন (অটোরিক্সা) ১১৬৯২, ফখরুল আলম (নৌকা) পেয়েছেন ৪৮৮৭ ভোট। ফাতেমা বেগম (মোটরসাইকেল) পেয়েছেন ২৯৭১, একেএম মহিউদ্দিন (আনারস) পেয়েছেন ৭২৪ ভোট এবং আবুল কাশেম (হাতপাখা) পেয়েছেন ৩৭১ ভোট।
অন্যদিকে শম্ভুপুর ইউনিয়নে মোঃ রাসেল (মোটরসাইকেল) পেয়েছেন ৬৯৯৬ ভোট, মোঃ মুঈনুদ্দিন (আনারস) ৬১৬১ ভোট, মোঃ মিজানুর রহমান (নৌকা) পেয়েছেন ১৩৬৪ ভোট এবং মোহাম্মদ জাফর (হাতপাখা) পেয়েছেন ২২৪ ভোট। তজুমদ্দিনে নির্বাচন কমিশন রাতে বেসরকারিভাবে এ ফলাফল ঘোষণা করেন।
নির্বাচন বর্জন করেছেন চাচড়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী রিয়াদ হোসেন হান্নান। ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম, কর্মী সমর্থকদের মারধরসহ নানা অভিযোগে এনে তিনি ভোট বর্জন করেন। সোমবার দুপুরে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচন শুরু হওয়ার সঙ্গে তার আনারস প্রতীকের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় প্রতিপক্ষ প্রার্থী নৌকার কর্মীরা। যেসব কেন্দ্রে এজেন্ট ছিল তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনের শুরুর আগে বহিরাগত লোকদের দিয়ে তার সমর্থকদের ১৫০টি ঘর ভাঙচুর এবং হামলা চালায়। এতে ১০০ কর্মী আহত হয়েছেন। ভোটের পরিবেশ না থাকা এবং নানা অনিয়ম হওয়ায় ভোট থেকে সরে গিয়েছি। বিষয়টি প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনকেও লিখিতভাবে জানিয়েছি। এ সময় ভোট বর্জন করে পুনরায় ভোটের দাবি জানান রিয়াদ হোসেন হান্নান। উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. আমির খসরু গাজী বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি।
এছাড়া মোবাইলফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করার অভিযোগে ভোলার তজুমদ্দিনে তিন এজেন্টকে তিনদিন করে কারাদ- দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার (২১ জুন) ভোট চলাকালীন সময়ে চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে তাদের এ কারাদ- দেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী আশরাফুর রহমান এ দ- দেন। দ-প্রাপ্তরা হলেন- মান্নান, শাহজাহান ও শাখাওয়াত। তাদের বাড়ি উপজেলার সম্ভপুর বদনাপুর গ্রামে। জানা গেছে, বিকেল ৩টার দিকে মোরগ, তালা, বই প্রার্থীর এজেন্ট ওই তিন ব্যক্তি সম্ভুপুর ইউনিয়নের ওই কেন্দ্রে মোবাইলফোন নিয়ে প্রবেশ করেন। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি দেখতে পেয়ে তাদের আটক করে কারাদ- দেন। চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. জাকির হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।