ঘূর্ণিঝড় ইয়াস
ভোলার পানিবন্দি এলাকায় কান্না থামছে না, দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ ॥ বিশুদ্ধ পানির সংকট
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ভোলার নিম্নাঞ্চল এলাকায় পানি কমে গেলেও মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। বরং ওই সব এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ যেন আরও বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা জেলার চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষের নীরব কান্না যেন থামছে না।
জানা গেছে, সাগরের ব্যাপক লবনাক্ত পানি ঢোকার কারণে এলাকার পানিবন্দি মানুষের মাঝে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার অধিকাংশ গভীর নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। ঘুর্নিঝড় ‘ইয়াস’ পরবর্তী মেডিকেল ইফেক্ট ডাইরিয়া মোকাবিলায় জনসাধারনের মাঝে খাবার স্যালাইন ও ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট বিতরন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
ঘুর্ণিঝড় ইয়াস চলে গেলেও ভোলার চরফ্যাশনের বিভিন্ন চর ও বেড়িবাঁধের বাহিরের বাসিন্দাদের দুর্দশা লাঘব হয়নি। কুকরি-মুকরি, ঢালচর, চরপাতিলা, চরমানিকা, মুজিবনগর সহ রসুলপুর, নীলকমল, চর কলমীর বেড়ীবাঁধের বাহিরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছু কিছু এলাকায় পানি কমলেও সর্বহারা হয়ে এলাকাগুলোর বাসিন্দারা হতাশ চোখে অজানার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে আছে। প্রায় ৪ দিনের জোয়ারের পানিতে হাবুডুবু খেয়ে প্রকৃতির আক্রোশের সাথে লড়াই করা মানুষগুলোর চোখে মুখে ক্লান্তি ও আতংকের রেশ এখনো কাটেনি। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ফসলাধি, গবাদিপশু পাখি ও সহায়সম্বল ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বিধ্বস্ত ঘর ভিটায় অবস্থান নিয়ে সরকারি সাহায্যের আশায় দিনযাপন করছে এসব এলাকার পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্ত নীলকমল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হাওলাদার বলেন, আমার ইউনিয়নে আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এমপির নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার, চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করেছি। তিনি সরকারে কাছে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতের ব্যবস্থা ও দ্রুত পর্যাপ্ত ত্রান সামগ্রী বরাদ্ধের অনুরোধ করেন তিনি।
ঘূর্ণিঝড় আর জোয়ারের কারনে কেউ হারিয়েছে ঘর বাড়ি সহ ভিটা মাটি। আবার কেউ বা দোকান পাট, পুকুরের মাছ, গবাদি পশু। সব কিছু হারা মানুষ গুলোর এখন দিন কাটছে চরম দুর্ভোগে। জোয়ার এলেই কেউ আশ্রয় নেয় উচু স্থানে। কেউ বা অন্যের বাড়িতে। এ চিত্র চরফ্যাশন উপজেলার কুকরি মুকরি, ঢাল চর, পর পাতিলা, মনপুরার কলতলি সহ বহু দুর্গম চরে। নিন্মাঞ্চলের দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ এখনো কাটছেনা। জোয়ারের পানি কমতে শুরু করলেও ঘুর্নিঝড় ইয়াসের আঘাতে লন্ডভন্ড অবস্থায় রয়েছে ভোলার দুর্গম বঙ্গোপসাগর মোহনার চরফ্যাশন উপজেলার জনপদ কুকরি মুকরি, চরপাতিলা, ঢালচরসহ বহু এলাকা। বিধ্বস্ত এসব জনপদে জেয়ারের পানিতে দেখা দিয়েছে লবনাক্ততা। এতে করে পুকুরের মাছ ও গবাদি পশু আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে কুকরি মুকরিতে। সাগরের লবনাক্ত পানি ঢোকার কারণে এলাকার পানিবন্দি মানুষের মাঝে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার অধিকাংশ গভীর নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।
চর পাতিলার হাসেম হাওলাদার সাংবাদিকদের জানান, মেঘনার জোয়ারের পানির আঘাতে তার ঘরসহ মালামাল ভাসিয়ে নেয়। এর পর তার স্ত্রী রোসনা বিবিকে নিয়ে আশ্রয় নেয় ছেলে নিজাম হাওলাদারের ঘরে। ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নিজামের ঘরের ভিটিসহ একাংশ জোয়ারে ভেসে গেছে। চার দিকে থৈ থৈ পানির মাঝে কোন রকমে ঘরে মাঁচা করে থাকছেন তারা সবাই।
নিজাম ছাড়াও রোসনা বিবির আরও ৫ ছেলে বারেক হাওলাদার, বাদশা, বশির, কাদের ও কাজল একই এলাকায় বসবসাস করেন। সবার ঘরের মাটি পর্যন্ত জোয়ারে ভেসে গেছে। পানিতে তলিয়ে ছিলো ৪ দিন। খাল, বিল সব নোনা পানিতে তলিয়ে থাকায় খাবার পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
হাসেম হাওলাদার পরিবারের মতো বহু পরিবারের এখন এমন করুন অবস্থা চর পাতিলা, ঢাল চর সহ বিভিন্ন দুর্গম চলাঞ্চলে। ঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ বলছে, জরুরী পুনর্বাসন ছাড়া বিধ্বস্ত পরিবার গুলোর পক্ষ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
চরফ্যাশন উপজেলারর চর কুকরি মুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, তার ইউনিয়নে বিধ্বস্ত এসব জনপদে জেয়ারের পানিতে দেখা দিয়েছে লবনাক্ততা। এতে করে এক দিকে যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। তেমনি চর কুকরি মুকরিতে লবনাক্ত পানির কারনে পুকুরের মাছ ও গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। তার ইউনিয়নের সব চাইতে ক্ষতি হয়েছে চর পাতিলা গ্রামে। সেখানে শতাধিক ঘর বাড়ি সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়। এছাড়াও আংশিক ক্ষতি হয়ে ২ শতাধিক ঘর বাড়ি। এ পর্যন্ত প্রশাসনের কাছ থেকে শুধু মাত্র শুকনো মুড়ি শুকনো খাবার বিতরণ করেছে। এছাড়া ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে যাদের তাদের জন্য তেমন কিছু এখনো পায়নি বলেও জানান।
ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, জোয়ারের পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি। গবাদি পশু গরু ছাগল, মহিষ হাঁস মুরগির সব চাইতে ক্ষতি হয়েছে।
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, উপজেলার চরমানিকায় সরকারী ত্রাণ দেওয়া শুরু হয়েছে, দ্রুত পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি ত্রান কার্যক্রম শুরু হবে।
মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল মমিন টিটু ভূইয়া জানান, শুধু তার ইউনিয়নে ৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মনপুরা উপজেলা চেয়ারম্যান সেলিনা চৌধুরী বলেন, ত্রাণ সাহায্য হিসাবে শুধু শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। যা এখনো চলমান রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের দ্বায়িত্বে থাকা জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মো: মোতাহার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ভোলা জেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রায় ৪ হাজার ৩’শ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বাড়ি-ঘরেরই আংশিক ক্ষতি হয়েছে। তাদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ঝড়ে নিহত ১জনের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। ঘর বাড়ি হারানো বিধ্বস্ত পরিবার গুলোর পুর্নবাসনের জন্য ভোলা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মধ্যে নগদ অর্থ ও ঢেউ টিন বিতরণ করা হবে।
ভোলা সিভিল সার্জন ডাঃ সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আসার আগে থেকেই ভোলার সব উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা প্রস্তুত ছিল। তারা এখনো দুর্গত এলাকায় কাজ করছেন। বিশেষ করে ঝড়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত চরফ্যাশনের চরকলমীসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের পানিবন্দি এলাকায় স্বাস্ব্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্বাস্ব্যকর্মীরা। গত শনিবারও ভোলা সদর উপজেলায় ঘুর্নিঝড় ‘ইয়াস’ পরবর্তী মেডিকেল ইফেক্ট ডাইরিয়া মোকাবিলায় জনসাধারনের মাঝে খাবার স্যালাইন ও ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট বিতরন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো: তৌফিক ই লাহী চৌধুরী জানান, তারা ক্ষত্রিগ্রস্তদের তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। এছাড়া দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।