আজ তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের বিসিএস অফিসার আব্দুর রশিদ এর ৩২ তম মৃত্যু বার্ষিকী

আজ তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের সৎ, নিষ্ঠাবান ও চৌকস বিসিএস অফিসার আব্দুর রশিদ এর ৩২ তম মৃত্যু বার্ষিকী।
আব্দুর রশীদ ১৯১৩ ইং সালের ১লা অক্টোবর ভোলা জেলার সদর থানার নবীপুর গ্রামের এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আলী হোসেন ও মাতা মেহেরুন নেসা। আব্দুর রশীদ এর বয়স যখন আড়াই বছর (৩০ মাস) তখন তাঁর পিতা ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ নামক জায়গায় উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা, তা হলো শিক্ষা জীবন অবস্থায় সেখানে তিনি টাইফয়েড জ্বওে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন।
আব্দুর রশীদ ছ্টোবেলাই পিতৃহারা হলেন। ছ্টোবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও জ্ঞানী ছিলেন। তিনি ভোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি বরিশাল বি,এম, সরকারী কলেজ থেকে ১৯৩০ সালে ২য় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৩৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফিতে অনার্স ও ১৯৩৪ সালে মাষ্টার্স সমাপ্ত করেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছ্ত্রা ছিলেন। তিনি ১৯৩৫ সালে বি,সি,এস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে একই বৎসর সফলতার সহিত কৃতকার্য হয়ে কোলকাতা সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে ১ বছর ট্রেনিং সমাপ্ত করে ১৯৩৭ সালে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন সরকারী কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ই,পি,সি,এস (ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) ক্যাডারভুক্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে নিয়োগ পান এবং বিচারিক পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি মহকুমা হাকিম হিসাবে রাজবাড়ী, জামালপুর ও মাদারীপুরে বিশেষ সফলতা অর্জন করেন।
১৯৩৫ সালে আব্দুর রশীদ ভোলার বিশিষ্ঠ আইনজ্ঞ জমিদার এম,এল,এ খান বাহাদুর নূরুজ্জামান (এম বি ই) (Member of Legislative Assembly and member of the order of the British Empire) একজন বিশিষ্ট আইনজীবি এর অত্যন্ত ¯েœহের ১ম কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ব হন। তাঁর স্ত্রী বিশিস্ট মুক্তিযোদ্বা, সমাজ সেবক, কবিরতœ ডঃ তাইবুন নাহার রশীদ।
ডঃ তাইবুন নাহার রশীদ ছোট বেলা থেকেই লেখালেখিতে অভ্যস্ত। ১৪ বৎসর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবি তাইবুন নাহার রশীদ তৎকালীন কলকাতার “মাহেনেও” পত্রিকায় লিখতেন। আব্দুর রশীদের স্ত্রী কবি তাইবুন নাহারকে ১৯৫০ সালে কলকাতার গৌরবঙ্গ সাহিত্য পরিষদ তাকে “কবিরতœ” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হবে” কবিতা লিখে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়েন। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী ছিলেন। মিসেস রশিদ ১৯৫১ সালে পি.ডব্লিউ.এন.জি’র পাকিস্তান মহিলা জাতীয় রক্ষীবাহিনীর (Pakistan Women National Guard) অনারারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত হন।
১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ডঃ তাইবুন নাহার রশীদ কর্তৃক প্রশিক্ষিত একটি দল দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে গার্ড অব অনার প্রদান করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তুলে দেন ক্যাপ্টেন ড. তাইবুন নাহার রশিদ। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গন অভ্যুথান, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। সবচেয়ে আশ্চর্য জনক ও বিস্ময়কর যা, তা হলো সুদূর আমেরিকার মিশিগান অঙ্গরাজ্যের Siena Heights University কতৃপক্ষ ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্বা, সুসাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক ও সমাজকর্মী এই মহীয়সী নারী বেগম তাইবুন নাহার রশিদের সাহিত্য চর্চা, নারীউন্নয়ন ও মানবসেবার জন্য আতেœাৎসর্গকারী হিসাবে তাঁকে Doctor of Humane Letters Degree (D.Lit) প্রদান করে বিরল সন্মানে ভুষিত করেন। এ সন্মান সমগ্র জাতির। ডঃ তাইবুন নাহার রশিদ তাঁর সমস্ত জীবনের সমাজ সেবা ও কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরুপ গত ৯ই ডিসেম্বর ২০১৫ ইং সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে “বেগম রোকেয়া পদক” (মরনোত্তর) প্রদান করে সন্মানীত করেন।
আব্দুর রশীদ সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও সুশিক্ষিত ১১ সন্তানের গর্বিত জনক। তার সকল ছেলে মেয়েরা দেশী- বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও উচ্চতর ডিগ্রী ধারী। তম্মধ্যে ২ ছেলে পিএইচ.ডি. ডিগ্রী ধারী। জনাব আব্দুর রশীদের বড় ছেলে ডঃ আবু হাসান মুর্শিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স থেকে ১৯৬৪ সালে এম,এ ডিগ্রী লাভ করে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রিয় সয়েল সার্ভে অব পাকিস্তানে নিয়োগ পান। পরে তিনি কানাডা খেকে পি,এইচ,ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর তৃতীয় ও চতুর্থ সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স ও এম,এ ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর পাঁচ কন্যার মধ্যে তিন কন্যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন।
আব্দুর রশীদ ১৯৬৮ সালে ৫৫ বৎসর বয়সে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থার জিল পাক সুগার মিলের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে জনাব আব্দুর রশীদ ইষ্ট পাকিস্তান রেডক্রসের সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে যোগদান করেন। স্বাধীনতা যুদ্ব শুরু হলে তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে আতœগোপন করেন। মুক্তিযুদ্বের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে মুক্তিযুদ্বের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে নিয়োজিত করে রাখেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আব্দুর রশীদ প্রথম বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়ার কারনে তিনি রেডক্রস থেকে অব্যাহতি নেন। তখন তাঁর স্ত্রী ডঃ তাইবুন নাহার রশীদ আওয়ামী লীগ সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যা। পরে বঙ্গবন্ধু জনাব রশীদকে Freedom Fighter & Rehabilitation নামে একটি সংস্থার প্রশাসক পদে নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে উক্ত চাকুরী থেকে অব্যহতি নিয়ে তিনি অবসর জীবন শুরু করেন। আব্দুর রশীদ ১৯৮৯ সালের ১৫ ই মে ঢাকার ডি,ও,এইচ,এস, বনানী- নিজ বাসভবনে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দৈনিক ভোলার বাণী পরিবার তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেছে।