আজ সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজাহানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী

সেদিন লাশ দেখার জন্য অগণিত মানুষের ঢল নামে ভোলা শহরে। প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর খবরে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আত্মীয়-স্বজন, দলীয় সহযোদ্ধা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কান্না ও আহাজারীতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্মের অবতারণা হয়। সেদিন রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা তাকে অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানান।
আজ ৫ মে ভোলা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, প্রাক্তন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আলহাজ মোশারেফ হোসেন শাজাহানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের এই দিনে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, শোক র‌্যালী এবং শহরের আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে কবর জিয়ারতের পাশাপাশি আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ছোট পরিসরে তার মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হবে।
আরো জানা গেছে, মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজান। তিনি ভোলা থেকে মোট ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ১৯৯১ সালে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, ২০০১ সালে ধর্ম মন্ত্রী ছিলেন। মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজান ১৯৩৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোলার ঐতিহ্যবাহী মিয়াঁ পরিবারে আলতাজের রহমান তালুকদার ও মাসুমা খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহন করেন। ৩ ভাই এর মধ্যে তিনি প্রথম। প্রথম জীবনে তিনি তিনি নাটক, সাংবাদিকতা, আবৃতি, ফটোগ্রাফিকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায়ই রচনা করেন নাটক ‘নীর ভাঙ্গাঁ ঝড়’ সেই নাটকে তিনি নিজেও অভিনয় করেছেন। ভোলা থেকে পাকিস্তান আমলে ‘পাক্ষিক মেঘনা পত্রিকা’ প্রকাশ করেছিলেন। তার উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে সর্ব প্রথম ভোলা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি সেই প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালের তিনিই সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক ভোলাবাণী প্রকাশের উদ্যোগ নেন।১৯৬৫ সালে মাত্র সাড়ে ২৫ বছর বয়সে এমপি নির্বাচিত হয়ে সম্পৃক্ত হন রাজনীতির সাথে।
তিনি ভোলার ১ম মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের দল প্রতিষ্ঠার পর পরই মোশারফ হোসেন শাহজাহান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে উপমন্ত্রীর মর্যাদায় বৃহত্তর বরিশালের জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী মনোনীত করেন। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভায় তাকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী করা হয় এবং ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তিনি ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলন সফল। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন অংগ সংগঠন ও রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন।
মোশারেফ হোসেন শাজাহানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর বলেন, মোশারেফ হোসেন শাজাহানের মত রাজনীতিবিদ বর্তমান সমাজে বিরল। তিনি নিরঅহংকার ও মানবতাবাদি মানুষ ছিলেন। তিনি সব সময় সমাজের কল্যাণের কথা ভাবতেন। যেখানেই মানবতার দূর্যোগ দেখা দিয়েছিল সেখানেই তিনি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন।
১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহাযার্থে ভোলার রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে চাঁদা তুলে সাহায্য নিয়ে সেদিন চট্টগ্রামের অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুধু সাহায্যই নয় ১৯৭০ সালের ভয়াবহ প্রলংকারী জলোচ্ছ্বাসে শত শত নিহতের পঁচা-গলা লাশ তিনি স্বহস্তে দাফন করেন। লঙ্গরখানা খুলে হাজার হাজার ক্ষুধার্থ মানুষের মুখে আহার তুলে দেবার ব্যবস্তা গ্রহণ করেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতীক জীবনে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
কেমন মানুষ ছিলেন মোশারেফ হোসেন শাজাহান এমন এক প্রশ্নের জবাবে তার একমাত্র ছেলে মোঃ আসিফ আলতাফ বলেন, “আমার বাবা শুধু একজন রাজনিতীবিদই ছিলেন না, তিনি একাধারে একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট, নাট্যকার, অভিনেতা হিসেবেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তিনি হানাহানির রাজনীতিকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবক। সমাজের অবহেলিত মানুষের উন্নয়নের জন্য তিনি বন্ধুজনের মতো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান করে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন, ভোলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে একজন। মুক্তিযোদ্ধের শুরুতে তিনি ছিলেন, ভোলার প্রথম সংগঠক ও নেতা।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ ট্রুম্যান বলেন, মোশারেফ হোসেন শাজাহান ছিলেন একজন সৎ মিষ্টভাষী নিরহংকারী অসম্প্রদায়িক, সাহিত্যিক এবং সহজ সরল ব্যক্তি। দল মতের উর্ধে তিনি ভোলার মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন। রাজনীতি ছিলো তার সমাজ তথা মানব সেবার অংশ। রাজনীতিকে পুজি করে তিনি ব্যাবসা করেননি, মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। মোশারেফ হোসেন শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। তার অবিস্মরণীয় বহুমূখী প্রতিভার কারণে তিনি অমর হয়ে থাকবেন ভোলাবাসীর অন্তরে। তার মৃত্যুতে ভোলাবাসী একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, আদর্শবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে।
উল্লেখ্য, মোশারফ হোসেন শাজাহান ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টসহ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের এই দিনে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি স্ত্রী, ৩ মেয়ে, ১ ছেলে, ২ ভাইসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।