জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৯০
ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন) :
(গত পর্বের পর) : ৬৯ এর গল্প : ঊনসত্তুর সাল ভোলার দক্ষিণ শাহজাবপুর চরফ্যাশন, লালমোহন, মনপুরায় লক্ষ লক্ষ নর-নারী প্রবল জলোচ্ছ্বাসে কোথায় কোন মহাসাগরে ভেসে চলে গেছে তা জানা যায় নি। তখন নভেম্বরের প্রবল ঠান্ডায় জলোচ্ছ্বাস থেকে কাউকে বাঁচানো যায় নি। মা-ছেলেকে দড়ি দিয়ে হাতের সাথে বেঁধে রেখেছে। তবুও প্রবল ¯্রােত ও শীত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে পারে নি।
আমি তখন ভোলায় অবস্থানরত। ঢাকা থেকে অল পকিস্তান ওম্যান এসোসিয়েশন থেকে সাহায্য নিয়ে চাল, ডাল, কাপড়, আসবাবপত্র সহ একপি লঞ্চে করে ভোলায় পৌঁছেছিলাম। গ্রাম-গঞ্জে অনেক লোকের মাঝে সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম। ভোলা নদীমাতৃক দেশ। তার উপর বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ¯্রােতের কত অসহায় নর-নারী কোথায় যে ভেসে চলে গেল। স্বামী-স্ত্রীকে পায় নি। স্ত্রী স্বামী, ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে সাগরের কুল ধরে ডেকে ডেকে যাচ্ছে। তাদের আহাজারিতে তখন ভোলার আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছিল। ঐ সময় পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী আমাদের দেশটাকে গিলে খাবার উপক্রম করল।
ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো বার বার ঢাকা এসেও সমঝোতায় আসতে পারে নি। আওয়ামীলীগের মেজরিটিকে কিছুতেই তারা মানল না। নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের পার্লামেন্টে বসার সুযোগ দিল না। দেশের জনগণ এ অন্যায় প্রত্যক্ষ করে পাকিস্তানীদের বিদ্রোহী হয়ে উঠে। পরিস্থিতির এক পর্যায়ে আন্দোলন ঘোরতর হয়ে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সব বন্ধ হয়ে গেল। ধর্মঘট ও আন্দোলন বিরাট আকার ধারণ করল। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দিলেন, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর সাথে মোকাবিলা কর, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম। আমরা দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
আমি তখন ঢাকায়, সেকেন্ড ক্যাপিটালে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে মেয়েদেরকে রাইফেল ট্রেনিং দেওয়ার জন্য বললেন। আমি সাজেদা চৌধুরীর বাড়ীতে দুইশত মেয়েকে রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া আরম্ভ করলাম। সেকেন্ড ক্যাপিটাল থেকে প্রত্যেক দিন রিক্সায় করে ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউজে এসে ৪টায় সকল মেয়েকে রাইফেল ট্রেনিং দেই। একদিন আইভি রহমান (জিল্লুর রহমান সাহেবের স্ত্রী) আমাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, আচ্ছা, মিসেস রশীদ, আপনি এত কষ্ট করে এসব মেয়েদের ট্রেনিং দেন, আপনার তাতে লাভ কী ? আমি বললাম, আমি দেশকে ভালবাসি। আর ট্রেনিং দিচ্ছি এই কারণে যে, মেয়েরা শুধু মার খেয়ে না মারা যায়, দু-চারজনকে মেরেই যেন মরে।
আমার স্বামী শুনেছে, চারদিকে গুজব ছড়াচ্ছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চিটাগাং এসেছে। গোলাবারুদ, মেশিনগান, রাইফেল নামছে শত শত। বাঙ্গালীদের মুরগীর মত একটি একটি করে মারবে। আমার স্বামী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভোলায় চলে গেল। কোলের ছোট দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে আমি এখানে পড়ে থাকলাম শুধু বঙ্গবন্ধুর আদেশে। আমি এগারটি ছেলে-মেয়েদের জীবন বাজী রেখে মেয়েদের রাইফেল শিক্ষা দিলাম। ২৩ শে মার্চে আওয়ামীলীগ থেকে হুকুম হল, বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অফ অনার দিতে হবে। দুইশত মেয়ে থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে নিয়ে আমার সাথে মার্চ করে চলল।
সাহারার হাতে বাংলাদেশের পতাকা, আমার হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। দু’শত মেয়ে হাতে রাইফেল নিয়ে মার্চ করে মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে বীরদর্পে বীর মুক্তিযোদ্ধার মত এগিয়ে চলল, লেফট রাইট লেফট, কুই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি ছিল। তাই নিয়ে তিনি এসে তার বাগানে দাঁড়ালেন। আমি মেয়েদের এটেনশন করে এবং অর্ডার দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেজেন্ট আর্ম করে গার্ড অব অনার দিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই সরল-সহজ অনাড়ম্বর দিলখোলা ব্যবহার আজও আমার চোখের সামনে ভাসে। কত হাসি-খুশি মনের মানুষ, কত সাহস, কত দৃঢ়তা। যা তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। সেদিন তার সেই উচ্ছসিত ভাষণ শুনে, দৃঢ়তার ভাষণ শুনে আমিও সেদিন একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি ১১টি সন্তানের জননী। সব ভুলে দেশের ডাকে স্বাধীনতার ডাকে, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমি ছিলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আজ বঙ্গবন্ধু নেই। এক মস্ত বড় অজগর এক রাতের অন্ধকারের ভিতরে বঙ্গমাতাকে, বঙ্গবন্ধুকে, জামাল, কামাল, ছোট শিশু আদরের রাসেলকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।
(চলবে——-)