বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা ‘বাংলা’ : ইউনেস্কো

ভাষা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এথনোলগ’র সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে (২৩তম সংস্করণ) তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বের ১০০টি বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকা। সেই সঙ্গে সংস্থাটি তুলে ধরেছে মাতৃভাষা হিসেবে ভাষাগুলোর ক্রমিক অবস্থান। সংস্থাটির মতে, পৃথিবীতে ৭ হাজার ১১৭টি জীবন্ত ভাষা রয়েছে। এরমধ্যে মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষা তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে সপ্তম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলায় কথা বলেন ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলা ভাষীর সংখ্যা ৩১ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হয়ে থাকে।
মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির অবস্থার বাংলার পরে, ষষ্ঠ স্থানে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর অবস্থান ১৮তম। এছাড়া পাকিস্তানের লাহান্দা ভাষা রয়েছে বিশ্বভাষা তালিকার দশম স্থানে এবং ভারতের তেলেগু, মারাঠি ও তামিল ভাষার অবস্থান যথাক্রমে ১৫তম, ১৬তম ও ২০তম। বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় শীর্ষ দশ ভাষার অন্যগুলো হচ্ছে মান্দারিন (চীনা), ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফরাসি, আরবি, রুশ, পর্তুগীজ এবং ইন্দোনেশীয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা বাংলা। বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কাছার জেলায় প্রচুরসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। কাছার জেলারও অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে বাংলাতে ঘোষণা দেয়া হয়।
এদিকে, জাতিসংঘের সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক অধিসংস্থা ইউনেস্কো পরিচালিত ২০১০ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘বাংলা’ বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা। এর পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিষ্টি ভাষার মর্যাদা পায় যথাক্রমে ‘স্প্যানিশ’ ও ‘ডাচ’ ভাষা। এত বছর পরও সে সমীক্ষার ফলাফলের ব্যত্যয় ঘটেনি। সত্যিই বাংলা ভাষা মায়ের মতোই মধুর। এমন মধুর ভাষার জন্য কী চুল পরিমাণ ছাড় দেয়া যায়? তাইতো এ জনপদের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দিতেও এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি।
ভাষার মাসখ্যাত ফেব্রুয়ারির সপ্তদশ দিন আজ। ১৯৫২ সালে দিনটি ছিল রোববার। এদিন লাহোরে মুসলিম লীগ নেতা সরদার আবদুর রব নিশতার এক সভায় বক্তৃতাকালে বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি যে, পাকিস্তানে জাতীয় ভাষার মর্যাদা একমাত্র উর্দুই লাভ করিবে।’ একই সময়ে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর জাহিদ হোসেন স্টেট ব্যাংকে উর্দু চেক প্রচলনের প্রস্তাব করেন।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ডা. আহমদ রফিক তার ‘ভাষা-আন্দোলন, ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে লেখেন, ‘একদিকে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের প্রধান প্রধান শহরে-গঞ্জে ভাষার দাবিতে যখন পরিবেশ উত্তপ্ত তখনও মুসলিম লীগ নেতাদের কেউ কেউ উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দ্বিধা করেননি। হয়তো তাদের ধারণা ছিল এর ফলে পূর্ববঙ্গের ভাষা-উত্তাপ কিছুটা কমে আসবে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ কর্তৃক বিরচিত বহুল পঠিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘গাভীর হাম্বা রব যদি ভাষা হয়’। ওই অধ্যায়ে ভাষা আন্দোলনের অনিবার্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের কথা তুলে ধরেন ফয়েজ আহমেদ। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প পরই পঞ্চাশের গোড়ার দিকে পূর্ব-বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ধারার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে সময় থেকেই যদি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা এবং কবি-সাহিত্যিকদের গোষ্ঠী নিশ্চিত প্রচ-বিরোধিতার মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে এগিয়ে না আসতেন, তবে হয়তো ত্রিশ বছর পর আজকের বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটি অধোগতি সম্পন্ন বিজাতীয় চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যেত। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিদেশমুখীতার বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বলীয়ান শক্তিধরদের তুলনায় তারা ছিলেন মুষ্টিমেয়।

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।