জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৪৯

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন)

(গত সংখ্যার পর) : আজিমের এক বড় সৎ ভাই ছিল মৌলভী। তার তত্ত্বাবধানে রেজা বড় হয়। তিনি রেজার বিদ্যাশিক্ষার ভার নেন। তার চেষ্টায়, তার যতেœ রেজা এম.এ পাশ করেন। ভদ্রলোক বড় ভাল লোক ও জ্ঞানী ছিলেন। গ্রামের উন্নতির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা তাকে ভুল বুঝল। একদিন রাত্রে এসে গলা কেটে রেখে গেল। তখন রেজা সিরাজগঞ্জে, মিঠু বয়স তখন ১ বছর।
তারপর থেকে আজিমের পড়ার ভার রেজা গ্রহণ করে। রেজার সাথে রেশমীর বিয়ে মৌলভী সাহেবের একান্ত আন্তরিকতায় ও আগ্রহের সাথে হয়েছে। মৌলভী সাহেব রেশমীকে যখন দেখতেন বড় ¯েœহ করতেন ও ভালবাসতেন। উনি নাকি রেশমীর বোন জোনাকীকেও কুরআন পড়িয়েছিলেন। সেজন্য যখনই তিনি বয়রা থেকে খুলনায় আসতেন, হাতে করে কিছু ফল-ফলাদি নিয়ে আসতেন। রেশমীর মাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন।
রেশমী দুইটি ছেলের মা হয়ে গেল- অথচ রেশমী এখনও ভাল করে বুঝতে পারল না রেজা তাকে ভালবাসে কি না। সব সময় রেশমীকে কথায় কথায় মারপিট করে। অযথা বকাবকি করে। রেশমী তা সহ্য করে নেয়। যে মুখ দিয়ে বাসর ঘরে সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল ঐ রাতে রেশমী ছাড়া অদ্বিতীয় আর কেউ ঘনিষ্ঠ ছিল না ! যে হাত বাসর রাতে রেশমীর বুকে তুলতে থরথর করে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল, সেই হাত দিয়ে প্রতিনিয়ত রেশমীকে মারে। দু’হাত দিয়ে গলা টিপে ধরতে যায়, ছোরা বসিয়ে দিতে চায়। রেজা বলে রেশমীর মা খারাপ, বাবা পাগল। রেশমীর বাবাকে পাগল বলতে রেশমী কোনদিন শোনে নি। তাকে লোকে খুব শ্রদ্ধা করত। রিটায়ার্ড জীবনে খুব ধর্মভীরু ও খোদাভক্ত ছিলেন। রেশমীর মা গ্রামের মেয়ে ছিল। অথচ তার মত জ্ঞানী মহিলা খুব বিরল। বিখ্যাত বার ভূঁইয়াদের বংশধর সে। তার স্বভাব, চরিত্র, কাজ-কর্ম, চলাফেরা সে খুবই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। সে অসম্ভব গুনী, সেলাই, হাতের কাজ ও রান্নাবান্নায় পাকা মহিলা। পাড়া প্রতিবেশীদের প্রতি খুব সুহৃদয় ব্যক্তিত্ব। এ পাড়ায় সে ৪০ বছর ধরে বাস করছে। সেখানে উকিল, মোক্তার ও সুধী সমাজের লোক বাস করত। কারো সাথে কোনদিন তার ঝগড়া হয় নি। পাড়ার লোকদের সাথে এক সহোদরের মত বসবাস করত। সে খুব ধর্মভীরু ছিল। ফকির, মিসকিনদের সব সময় দান খয়রাত করতেন। কোন ভিখারী রেশমীদের বাড়ী থেকে ভিক্ষা না নিয়ে খালি হাতে ফিরেনি। বাহির বাড়ীর দহলিজে সব সময় একজন মৌলভী সাহেব থাকতেন। তার প্রতি এই বাড়ীর আদেশ ছিল সব সময় কুরআন তিলাওয়াত করার। রমজান মাসের প্রত্যেক শুক্রবার গরীব-ধনী সবাইকে ইফতার খাওয়ানো হতো। অসহায় লোকদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল।
এই ছিল রেশমীদের পারিবারিক ঐতিহ্য। রেশমীর বাবা-মাকে সংসারের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে অনেক সময় ঝগড়া করতে দেখেছে। শেষ পর্যন্ত রেশমীর বাবাই পরাজয় স্বীকার করে বাহির বাড়ীতে চলে যেতেন। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে কখনো মারপিট ও অশালীন আচরণ করতে দেখে নি। অথচ তার স্বামীর আচরণ তার কাছে আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে সে ভীষণ কাঁদে। কেঁদে কেঁদে সেই মহান ¯্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ জানায়। রেশমী ছোট বেলা মার সাথে নানা বাড়ী যেত। দেখত নদীতে ঘরবাড়ী বিলীন হয়ে যাওয়া অনেক লোক ওর নানাদের জায়গায় থাকত। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন ঝগড়া হলে স্ত্রীকে বেদম মার দিত। চুলের মুঠি ধরে ঝুলিয়ে রাখত। বউটা হয়ত স্বামীর মারের ভয়ে ছুটে পালাতে চাইত। স্বামীটাও তার পিছু পিছু দৌড়াত। এ সব দেখে রেশমী কেঁদে ফেলত।
আজ সুদূর পরাহত জীবনে তার সংসারেই এ সব ঘটে গেল। ডান হাতটা কালো হয়ে আছে। রেজা একদিন তার হাতে এমন কিল মেরেছিল যে হাতটা ফুলে উঠেছিল। দু’দিন পর্যন্ত ভিজা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখতে হয়েছিল। রেশমী দুনিয়ার কারো কাছে বলতে পারে না। বাবা-মা শুনলেও কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে। লোকজন শুনলে হাসবে বা সহানুভূতি প্রকাশ করবে। রেশমীর এত বড় অপমান, এত লজ্জাস্কর কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মান-সম্মান, বংশ মর্যাদা তাকে দমিয়ে রাখে।

 

(চলবে——-)

আরও পড়ুন

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।