সর্বশেষঃ

ইসির একক আইনের উদ্যোগের কারণে সরকারের ‘না’

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনায় একক আইন দেখতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এজন্য একটি একক আইনের খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি। খসড়ার ওপর আইনটি প্রণয়নের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজের (অংশীজন) প্রতিনিধিদের অভিমত নেওয়ার জন্য তাদের কাছে পাঠিয়েছে ইসি। গত ১ অক্টোবর ইসি সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাশেমের সই করা পত্রসহ প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি পাঠানো হয় অংশীজনদের কাছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারের সব স্তরের নির্বাচন পরিচালনার সুবিধার্থে যে একক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, তা আমাদের দৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হয়নি। কেননা স্থানীয় সরকারের কোনো আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় করবে, সেখানে সাংবিধানিক সংস্থা ইসি শুধু মতামত ও পরামর্শ দিতে পারে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারের আইনগুলোর বিদ্যমান জটিলতা, অসংগতি ও করণিক ত্রুটি দূর করার লক্ষ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। সবগুলোকে একত্রিত করে আইনগুলোকে সমন্বয় করার কাজ করছে ওই কমিটি। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিক আরো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের একক আইন প্রণয়নের দেওয়া প্রস্তাব থেকে কিছু গ্রহণ করার সুযোগ থাকলে সেটি মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটি নিতে পারে। এর বাইরে কোনো আইন করার এখতিয়ার নেই কমিশনের।
এদিকে ইসির প্রস্তাবের ওপর অভিমত ও সুপারিশ জমা দিতে শুরু করেছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুধীসমাজের প্রতিনিধি ও অংশীজনরা। গতকাল সোমবার মতামত দিয়েছে বিএনপি। তারা ইসির প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছে। একইভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও আপত্তি জানিয়েছে ইসির একক আইন প্রণয়নের উদ্যোগে। এর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, পরামর্শ ও সুপারিশ ১ নভেম্বরের মধ্যে ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছিল।
ইসির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, স্থানীয় স্তরের (সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রতিটি ধাপের নির্বাচন পরিচালনা হয়ে থাকে ভিন্ন আইন ও বিধির আলোকে। এতে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত নির্বাচনী কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগে কিছুটা হলেও তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এর ফলে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কালেভদ্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটে থাকে।
ইসির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বছরজুড়েই শূন্য হওয়া উপনির্বাচন (জাতীয় সংসদ, সিটি, পৌর, জেলা পরিষদ, পৌর ও ইউপি) অনুষ্ঠিত হয়। প্রস্তুতি নেওয়ার সুবিধার্থে এসব নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় একসঙ্গে। সেই সঙ্গে ভোটও হয় এক দিনেই।
দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে ছোটখাটো ত্রুটির কথা উল্লেখ করে ইসি বলছে, আইনগুলোকে একক আইনে পরিণত করতে চায় তারা। যেমনটি রয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। ওই দুটি নির্বাচন পরিচালিত হয় একই আইন ও বিধিবিধানের আলোকে। কিন্তু স্থানীয় স্তরের সব নির্বাচন একক আইনের আওতায় নেই। তাই নির্বাচন পরিচালনার সুবিধার্থে স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের বিধিবিধান এক ছাতার নিচে রাখতে চায় ইসি, যাতে নির্বাচন পরিচালনায় তাদের কাজের ক্ষেত্র সহজতর হয়।
নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিস্তরের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক আইন আছে। সেগুলোর ভেতর কতিপয় অধ্যায় ও ধারার অধীনে নির্বাচন পরিচালনার বিধিবিধান সংযোজন করে দেওয়া আছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রণীত আইন অংশের অধিকাংশ উপাদান এক ও অভিন্ন। তাই ছোটখাটো ব্যতিক্রম থাকলেও তা সন্নিবেশ করে একটি একক আইন প্রণয়ন করা গেলে নির্বাচন পরিচালনার কাজ সহজতর হবে। সেই কাজটিই আমরা করেছি। তিনি বলেন, ‘এটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন অংশীজনের কাছে মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠিয়েছি। তবে আমরা আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন করবে সরকার বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন, কাজের ধরন এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একটা মর্যাদা আছে। একইভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের ক্ষেত্রেও মর্যাদা ও কাজের ধরনে ভিন্নতা আছে। এই দুটি স্তরের সঙ্গে তৃণমূলের সর্বশেষ স্তর অর্থাৎ ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের একত্রে মেলানো যাবে না। আবার সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর মেয়রদের কাজের ক্ষেত্র ও সরকারি সুবিধা সমন্বয় করা যাবে কি না সে প্রশ্নও তোলেন তারা। তাদের মতে, সব এক হলে সুযোগ-সুবিধাসহ সবক্ষেত্রে সমান রাখতে হবে। কিংবা আইনটি ওই পর্যায়ে নেওয়া হলে সবই যার যার স্তর থেকে সমান সুযোগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবেন। তবে ইসির পাঠানো আইনটি পর্যালোচনা করে যেটা যৌক্তিক হবে, সেই সুপারিশ ও মতামত দেবেন তারা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কাঠামোয় পাঁচটি ধাপ আছে। প্রতিটি ধাপের নির্বাচন এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজের ধরন ও পদমর্যাদায় তফাত রয়েছে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং পৌরসভার মেয়রের কাজ ও মর্যাদা যেমন এক নয়; তেমনি জেলা পরিষদ, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাজ ও পদমর্যাদার ধরনও ভিন্ন। তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সবস্তরের নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটি আইনের আলোকে এনে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে, যেটা আমরাও পেয়েছি। আমরা এটা পর্যালোচনা করছি। কাজের ভিন্নতা থাকার কারণে একক আইন করলে কোনো সমস্যা ও জটিলতা তৈরি হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখে কমিশনকে খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অভিমত জানিয়ে দেওয়া হবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় স্তরের নির্বাচন পরিচালনার জন্য একক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ ইসি না নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিলে ভালো হতো। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ইসি নির্বাচন পরিচালনা করে সরকার ও মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে। সুজন সম্পাদক আরো বলেন, শুধু একক আইন করলেই সমন্বয়হীনতা দূর হবে না। সমন্বিত আইন করতে হবে, যেখানে একটি ধারার বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সিটি, পৌর, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও ইউপির জন্য আলাদা আলাদা বিধিবিধান রাখতে হবে। যাতে নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তারা একটি ধারা দেখে স্তর অনুযায়ী নির্বাচন বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ ধরনের সমন্বিত আইন রয়েছে ভারতের কেরালায়।

সুত্র : প্রতিদিনের সংবাদ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।