জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট

পুরুষের টাকনুর ওপরে কাপড় ও নারীর হিজাব পরার নির্দেশনা (!)

সরকারি বিধি অনুযায়ী নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম তার অফিস চালাতে চান নিজের স্টাইলে। এজন্য তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ড্রেস কোড নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। বুধবার (২৮ অক্টোবর) জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা নারীদের জন্য হিজাব ও টাখনুর নিচে কাপর পরা এবং পুরুষের জন্য টাখনুর ওপর পোশাক পরা-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

এতে লেখা হয়, ‘এতদ্বারা ইনস্টিটিউটের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অফিস চলাকালীন সময়ে মোবাইল/ল্যান্ডফোন বন্ধ রাখা এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরুষ টাখনুর ওপর ও মহিলা হিজাবসহ টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক এবং পর্দা মানিয়া চলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন রাজধানীর মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি জারির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনি পর্দা মেনে চলার ব্যাপারে এমন নির্দেশনা দিতে পারেন কি-না বা প্রতিষ্ঠান প্রধান হলেও তিনি সরকারের অনুমতি ছাড়া এমন বিজ্ঞপ্তি প্রদান করতে পারেন কি-না, তা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ এমন বিজ্ঞপ্তিকে সরকারি চাকরি বিধির সাথে অসামঞ্জপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন তার এক ফেসবুক পোস্টে বিজ্ঞপ্তিটি শেয়ার করেছেন। এরপর এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে।

উৎসব মোসাদ্দেক নামে এক ব্যক্তি পোস্টটিতে বলেন, এ ধরনের নির্দেশ আমাদের সংবিধানের সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। সুপ্রভা তাসনিম নামে অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেন, বিজ্ঞপ্তিটি মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে এটা তো উনি কোনোভাবেই করতে পারেন না। উনি এমন কোনো নোটিস দিতে পারেন না। পাগল নাকি! আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি হাসপাতালের আধুনিকায়নের কাজে ঢাকার বাইরে আছি। ফিরে গিয়েই আমি এ বিষয়টি দেখবো।

এদিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিমকে শোকজ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টােবর) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে তিন কার্যদিবসের মধ্যে ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিমকে কারণ দর্শাতে বলা হয়।

পত্রে বলা হয়, অফিসের মুসলিম পুরুষ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অফিস চলাকালীন সময়ে টাখনুর উপর ও মহিলা কর্মকর্তা/কর্মচারীদের টাখনুর নিজে জামা পরিধান করাসহ মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান করে অফিস করার নির্দেশ এবং পর্দা মেনে চলার বিজ্ঞপ্তি কোন বিধিবলে ও কোন আদেশক্রমে দেয়া হয়েছে তা আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যাসহ জবাব দেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম সাংবাদিকদের বলেন, এ বিজ্ঞপ্তি শুধু অফিসের ভেতরে দিয়েছি। সংবাদপত্র বা ফেসবুকে দিইনি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে এ বিজ্ঞপ্তিটি দেয়া হয়েছে। টাখনুর ওপরে যদি পুরুষ কাপড় পড়ে তাহলে তার কোনও গুনাহ নাই, টাকনুর নিচে পরলে সে কবিরা গুনাহ করলো। একইভাবে নারীদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য, নারীরা পর্দার ভেতরেই সুন্দর। টাকনুর নিচে কাপড় পরলে তার কবিরা গুনাহ হবে না। এই জিনিসটা আমাদের দেশে উঠে গেছে। তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের পছন্দমাফিক রুচিশীল পোশাক পরিধান করতে পারবেন।

ড্রেস কোড নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাকে সরকার থেকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আমি আমার কলিগদের এ চিঠি দিছি নিয়ম-কানুন পালন করার জন্য। আমি আমার স্টাফদের সুশৃঙ্খলভাবে চালানোর জন্য এবং রহমতের সঙ্গে চালানোর জন্য এটা দিয়েছি।

তিনি নিজেই পালটা প্রশ্ন করেন, আমরা আজকে কি বিপর্যয়ে নাই?’ তিনি বলেন, এ দেশের কয়জন ইমাম-মুয়াজ্জিন, কয়জন হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ মারা গেছেন কোভিডে? আপনাদের সাংবাদিকদের অনেকেই গেছেন, পুলিশ গেছেন, ডাক্তার গেছেন- হেন পেশা নাই যে পেশাকে করোনা আক্রমণ করেনি, কিন্তু কয়জন ইমাম-মুয়াজ্জিন মারা গেছেন?

তার মানে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তারা সবাই পাপী ছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এ কথা বলছি না। ধর্মীয় অনুশাসনের জীবনযাপন জরুরি। অন্যরা কোন কারণে মারা গেছেন সেটা আমি জানি না।

তিনি আরো বলেন, সবাইকে পরিচালনা ঠিকমতো করতে পারছি না, এটা আমার দায়িত্বে অবহেলার নজির বলে মনে করছি। আমি একজন বিসিএস কর্মকর্তা। আমি আমার অফিস চালাবো আমার স্টাইলে।

কিন্তু আপনার স্টাইলে সরকারি অফিস চালাতে পারেন কিনা, সরকার সে দায়িত্ব দিয়েছে কি—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি তাহলে মামলা করেন, অসুবিধা কী? অথবা আমার অফিসে আসেন, কথা বলি আপনার সঙ্গে।

তিনি বলেন, এ নির্দেশের সঙ্গে আমি আরও বলেছি, অফিস চলাকালীন মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখবেন অথবা অফ করে রাখবেন। সরকারের কর্মঘণ্টাগুলো মোবাইল বা ফেসবুকে চালাইয়া নষ্ট করতেছেন। নৈতিকতা আমাকে শেখাবেন না।

পরিচালক হিসেবে আপনি করতে পারেন না মন্তব্য করলে তিনি বলেন, সেজন্য আপনি জবাব নেওয়ার কেউ না, সে জন্য আমার প্রশাসন রয়েছে, তারা দেখবে।

পরিচালক হতাশার সুরে আরো বলেন, ভালো একটি নির্দেশনা ভাইরাল হয় কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে যে সকল ভালো ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা ভাইরাল হয় না।

‘পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কে কে তিন বছরের অতিরিক্ত সময় এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন, তাদের কার কাছে কী কী অর্থসম্পদ রয়েছে, কে কতটুকু জাকাত দিচ্ছে, সকাল বেলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রতিটি কক্ষে জাতীয় সঙ্গীতের আয়োজনসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেসব ভাইরাল হয় না। পর্দা মেনে চলার ব্যাপারটি ভাইরাল ও সমালোচনা হয়, যা দুঃখজনক’, যোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম।

সুত্র : পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।