সর্বশেষঃ

করোনার মধ্যেও গতি ফিরছে অর্থনীতিতে

করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির মধ্যেও ভালোর দিকে এগোচ্ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো। বড় অর্জন এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে। রফতানি আদেশে গতি আসছে পোশাক খাতে। ফলে পুরোপুরি খুলে গেছে কলকারখানা। সুশাসনের উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ব্যাংকে লেনদেনও চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতোই। ফলে অনেকটাই স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। আর অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর সচলতায় দেশব্যাপী বাড়ছে কর্মচাঞ্চল্য। এসব বিবেচনায় সার্বিকভাবে মহামারির প্রভাব কাটিয়ে পুনরুদ্ধার হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য মিলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। করোনার মধ্যেই গত মাসে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের বছরের আগস্টে এই পরিমাণ ছিল ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। তাছাড়া আগের সব রেকর্ড ভেঙে জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা যা আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় প্রায় ৬৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ।
মহামরির মধ্যেও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে শুরু হয়েছে অর্থবছর। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে দেখা যাচ্ছে চাঙাভাব। এতে দেশের চলতি হিসাবে বড় ধরনের উদ্ধৃত হয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য-বাণিজ্যে ঘাটতি কমেছে। মূলত আমদানির চেয়ে রফতানি বৃদ্ধির হার বেশি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ কমেছে। উল্লিখিত সময়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২০-২১ অর্থবছরের আগস্ট মাসের বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবে ভারসাম্যের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বর্তমানে অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে সরকারের বলিষ্ঠ নীতি সহায়তাসহ সব পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে। এটি আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তবে করোনা মহামারির দ্বিতীয় যে ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটি মোকাবিলার জন্যও সরকারসহ আমাদের সব পক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ থাকতে হবে। কারণ বর্তমানে অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার হয়েছে সেটি যাতে থেমে না যায়।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো।
ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ৬৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে প্রায় ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। সেই হিসেবে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২০৫ কোটি ডলার। উল্লিখিত সময়ে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি হয়েছে। বিপরীতে পণ্য আমদানির ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি অর্থনীতির প্রভাব বুঝা যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ দেখে। এটি এখন ৪০ বিলিয়ন বা ৪০০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তাই জোর দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার আরেকটি উপাদান হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি। বিবিএসের হিসাবে কোভিড-১৯ এর মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। সেই সঙ্গে দেশে মাথাপিছু আয়ও দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলারে। এই সূচকগুলোই অর্থনীতি সচল হওয়ার নির্দেশক।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামনে অর্থনীতির জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এর বড় কারণ হচ্ছে, করোনা মহামারির কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাদের আবার কাজে ফিরিয়ে আনাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।
কোভিড-১৯ এর সময় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এরই মধ্যে উদ্যোক্তারা এই প্যাকেজের টাকা নেওয়া শুরু করেছেন। তাছাড়া করোনার মধ্যেও কলকারখানা চালু রাখায় এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা সবই বর্তমানে চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতোই।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।