জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৩৯

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন)

(গত সংখ্যার পর) : খোদা যা করেন তা নাকি মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। রেশমী যে কেন বেঁচে উঠেছিল তা রেশমী জানে না। তবুও যেন সে বেঁচে শান্তি পেল না। তার মনে অহরহ অনুশোচনা হত, খোদা কেন তুমি আমাকে বাঁচিয়ে তুললে ? রেজা মাঝে মাঝে চিঠি লিখে, কখনো লিখে না। রেশমী জোর করে না। জোর করতেও সে জানে না। ভালবাসা কারো কাছ থেকে জোর করে আদায় করা যায় না। ভালবাসা একান্ত মনের জিনিস। তা নিজের থেকেই সৃষ্টি হয়। নিজে নিজে এর মৃত্যু ঘটে।
দেখতে দেখতে বর্ষা এসে গেল। বর্ষার সিক্ত ধারায় পৃথিবীর কালিমা ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। রূপে গন্ধে রসে আপ্লুত হয়ে উঠল, নব মঞ্জুরী ময়ূরী পেখম তুলে নাচল বর্ষার জলে। বর্ষা যখন অঝোর ধারায় ঝরে পড়ত, ঝুম ঝুম করে তখন রেশমী রেজার কথা ভাবত। রেজা ভাবত কিনা জানত না। রেজা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে থাকে, বিসিএস পরীক্ষা দিবে বলে। পরে কলকাতায় চলে যায়। তালতলা লেনে থাকত। সেখান থেকেও রেশমীকে চিঠি লিখত। তালতলা থেকে ফিরে আসার তিন মাস পর রেজার চাকুরী হল সিরাজগঞ্জের সার্কেল অফিসার। সিরাজগঞ্জ থেকে যখন শাহবাজপুর বদলী হল, তখন একদিন রেজা খুলনা থেকে রেশমীকে নিয়ে এল।
রেশমী তখন ছোট একটা মেয়ে। বয়স তার ১৬ বছর প্রায়। গাড়ী ভ্রমনে রেশমী খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। ঈশ্বরদী স্টেশনে রেজা রেশমীকে মাথা ধুয়ে দিল। রেশমী অবাক হয়ে ভাবে, আর লোকটাকে দেখে, মা-বাবাকে ফেলে এসে রেশমীর যেন অসহায় মনে হচ্ছিল। সারা পথে বিশেষ করে মার কথা মনে পড়ছিল। চোখ দিয়ে তার পানি ঝরছিল, ভাই বাঁশির জন্য মনটা ছট্ফট্ করছিল। সন্ধ্যায় এসে উল্লাপাড়া স্টেশনে গাড়ী থামল। সেখান থেকে পালকী করে নৌকায় উঠল। পালকীতে উঠতে রেশমীর বড় ভয় করছিল। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ী যেতে রেশমী কিছু সময়ের জন্য পালকীতে উঠেছিল। আর আজ তার মন চঞ্চল বিহীন কি যেন হারানোর ব্যথা অনুভব করছিল।
এরপর তারা গিয়ে শাহাজাদপুর নামল। রেশমীর মন যেন আরো নিরব মনে হলো। মনের সুর যেন কোথাও হারিয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো একটি কিশোরী অবুঝ মন। তবুও রেজার মনকে খুশি করার জন্য রেজার সুরের সাথে তার সুর মিলিয়ে নিল। রেজা প্রায়ই মফস্বলে থাকে, মাঝে মাঝে রেশমীকেও নিয়ে যায় নৌকায় করে। সেই যমুনায় দিগন্ত বিদারী ব্যাকুল যৌবন তাকে যেন হাত দিয়ে ইশারা করল। আহ্বান করল তার দলে নামার জন্য। রেশমী যেন অবনত মস্তকে তাকে কুর্নিশ করল। ভাল লাগল নদীর অপরূপ উচ্ছল ছল ছল কল কল তান। নৌকা ভেসে যায় দূর হতে দূর দেশে। পাট ক্ষেতের উপর দিয়ে চলে যায় আপন মনে, মাঝিরা বিরহ বেদনার গান গায়। রেশমীর দু’চোখ ভরে পানি এল। তার মনের কথাই যে তারা গেয়ে চলছে। রেজাকে যেন রেশমী আরো ভালবাসতে লাগল। রেজাকে ছাড়া খায় না। সে বিশ্রামে যায় না। ছোট একটা শিশু চরিত্রে সে অসহায় দুর্বল।
রান্না হয়ে গেলে রেজা এসে চেয়ারের পিছনে দাঁড়ায়। রেজা তখন অফিসের ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। রেশমী বলে ‘উঠ’ গোসল কর। রেজা তবুও কাজ করে, রেশমী আবারও অনুরোধ করে। রেজা উঠে গোসল করতে যায়। দু’জনে একখানে খায়। রেজা রান্নার প্রসংশা করে, রেশমী খুশি হয়। রেশমী নিজেই পাক করে, নিজের হাতেই বিকালের নাস্তা করে, রেজা খুশি হয়। সে খুশিই রেশমীর মনে আনন্দ এনে দেয়। তখন তরৎ কাল, পাখির কলগানে শিশির সিক্ত, প্রভাত উদার মেঘমুক্ত নীল আকাশ। নীল আকাশের নীলের খেলা রেশমীর মনকে ছুয়ে যেত, রেশমীর ভাল লাগত আরো ভাল লাগত দূর-দূরান্তব্যাপী কাশবন। ভাদ্রের উজান নদীতে স্টীমার আসা-যাওয়া করত। রেশমী চেয়ে দেখত আর বাবা-মার কথা মনে করে কাঁদত। মনে হতো ঐ স্টীমারে করে সে চলে যায় মা’র কাছে। কত লোক নামত, কত লোক উঠত, কত দেশের পন্যদ্রব্য, কত দেশে চলে যেত।

(চলবে————)।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।