বিপুল পরিমান জমির রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

১৫০ বছর পরও মনপুরার চর ডেমপিয়ারের জমির মালিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে গেল

ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশের অর্ধ শতাব্দিতেও ভোলার মনপুরা উপজেলার চর ডেমপিয়ারের রেকর্ডিও জমির মালিকরা তাদের জমির পূর্ণ অধিকার ফিরে পেল না।
সূত্রে জানা গেছে, ২০ শত শতাব্দীতে তদানিন্তন সুন্দরবনের কমিশনার মিস্টার ডেমপিয়ার এর নামে, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার রেনাল, সার্ভেলাইন অনুসরন করে এই চরকে জমিদারের সম্পত্তির অন্তর্গত বলে সাবস্ত করে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাকেরগঞ্জ জেলায় ক্যালেক্টর তদানিন্তর বোর্ড অফ রেভিনিউ অনুমতি নিয়ে মামলা নং-৯০/১৮৯৫ বাকেরগঞ্জ জজকোর্ট রায় দাখিল করেন।
১৯০৩-৪ সালে অনুষ্ঠিত জরিপে দেখা যায় চর ডেমপিয়ার মৌজা বাকেরগঞ্জ জেলার বোরহানউদ্দিন থানায় অর্ন্তগত জে,এল নং ৩৩৭০ তখনকার জরিপে জমির পরিমান ছিল ২৩৪৪ একর (বোরহানউদ্দিন থানার অধিন) জরিপের প্রেক্ষিতে এবং মামলার রায়ের ফলাফলে ১৯০৬ সালে এই জমি জমিদারের খাতিয়ান ভূক্ত হয়। পরবর্তিতে ১৯১৬ সালে ১৫৭ নং মামলা ১৯১৮ সালে ০৬ নং মামলা বরিশাল জেলা জজ আদালতে জমিদারের পক্ষেই নিস্পত্তি হয়। পারবর্তী বিভিন্ন আদালতের মামলার রায় ও সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষতে ১৯৫০ সালে ডেমপিয়ার মৌজার ২৮৮৮ একর জমি ঐ অঞ্চলের জমিদার রাজা রাজেশকান্ত রায় চৌধুরীর পক্ষে বাকেরগঞ্জের কালেক্টরের অনুমোদনক্রমে বাকেরগঞ্জ কোর্ট অফ ওয়ার্ডস মনপুরা নিবাসী জনাব আবুয়াল ফাত্তা মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধূরীকে গবাদি পশু পালনের জন্য চার (৪) বছরের জন্য ইজারা প্রদান করেন।
১৯৬৪ সনে রাজা রাজেসকান্ত রায় তার বাকেরগঞ্জ জেলায় জমিদারির তৌজি নং- ১৭৬৩/৬৪, দক্ষিণ শাহাজবাজপুরের জমি ব্যবস্থাপনার জন্য মনপুরা নিবাসী জনাব কমাল উদ্দিন চৌধূরীকে পিতা আবুয়াল ফাত্তা মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধূরীকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেন। ১৯৫৪ সালে প্রজাসত্ত্ব আইন পাস হওয়ায় পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। তখন এই জমিদার ৩৬০ জন প্রজার মধ্যে চর ডেমপিয়ারের জমি বন্ধোবস্ত দেন। ১৯৫৬ সনের ২৬ শে জুন তারিখে ৭৬৩৩ নং গেজেট মুলে ইহা রেকর্ড ভূক্ত হয়। ১৯৬০ সনে মেম্বার বোর্ড অফ রেভিনিউ (পূর্ব পাকিস্তান) নোয়াখালী জেলা কালেক্টরের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নোয়াখালীর জেলায় সীমানা ভূক্ত করেন। অতপরঃ রেকর্ডিও মালিক গন ১৫৯/১৯৬০ বাকেরগঞ্জ জেলা আদালতে দায়ের করেন। এই মামলায় বাকেরগঞ্জ জেলার রেকর্ডিও মালিক গন আদালত কর্তৃক জমির মালিকানার স্বীকৃতি লাভ করেন। অতপরঃ নোয়াখালী কালেক্টর চর ডেমপিয়ার শত্রু সম্পত্তি বলে দাবী করেন। কিন্তু মামলা নং ১১১/১৯৬৯ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট ইহা শত্রু সম্পত্তি নয় বলে ঘোষনা করেন, জমির মালিকগন ১৯৯১ সনে ভূমি জরিপ অধিদপ্তরে আবেদন জানাইয়া ভোলা উপজেলার জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেন। অতপরঃ মালিকগন ভোলার দেওয়ানী কোর্টে মামলা নং- ১২/১৯৯২ দায়ের করেন। এই মামলায় আদালত রেকর্ডিও মালিকদের ভূমি কর আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন। ১৯৯২ থেকেই কতিপয় রেকর্ডিও মালিক জমির কর পরিশোধ করে আসছেন। ১৯৬০ সালে নোয়াখালীর কালেক্টরের উদ্যোগের কারণে চর ডেমপিয়ার কোন জেলায় অন্তর্গত ঐ প্রশ্ন থেকেই যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জমি নিয়ে চর ডেমপিয়ারের বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারী অপরাধ সংগঠিত হয়। বেশ কয়েকটি মামলা নি¤œ থেকে উচ্চ আদালতে গিয়ে নিস্পত্তি হয়।
এরমধ্যে ২৮/১৯৬২, ৯০/১৯৬২, ১৩৩/১৯৬৩, ২১৯/১৯৬৮ সকল মামলায়ই পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা হাইকোর্টে নিস্পত্তি হয়। ১৩/বি-১৯৬৬ আপিল মামলা পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট এ নিস্পত্তি হয়। এই সকল মামলায় রায়ে চর ডেমপিয়ার বাকেরগঞ্জ তথা তদানিন্তক ভোলা মহকুমার আওতাধীন রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ হাই কোর্টের মামলা নং ৭৩৭৫/২০০৮ রায় অনুযায়ী ঢালচর মনপুরার উপজেলার অন্তর্গত বলে রায় হয়।
অন্যদিকে সরকারে ভূমি মন্ত্রণালয় ১৬-০৩-১৯৯৬ প্রজ্ঞাপন নং-১২৭ অনুযায়ী ঢালচর ভোলা জেলার অর্ন্তগত বলে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ১৮-০৬-২০০৯ পত্র অনুযায়ী চর ডেমপিয়ার মনপুরার অর্ন্তগত বলে ঘোষনা দেয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালী জেলায় হাতিয়া উপজেলার একদল লোক ঢালচরের উত্তর অংশ তাদের দখলে নেয়। এই সমুদয় জমির মালিক ভোলা জেলার বিভিন্ন রেকর্ডধারীগন। উচ্চ আদালতের এতগুলো রায় এবং সরকারে সুস্পষ্ট সিন্ধান্তের পরেও ভোলা জেলার রেকর্ডিও মালিকরা তাদের জমি ভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দীর্ঘ দিন যাবত।
মেঘনার ভাঙ্গনে বাস্তুভিটা বিলীন হওয়া এ সকল মানুষের জমি রয়েছে এই চরে। কিন্তু নোয়াখালীর কতিপয় ভূমিদস্যু যাদের বৈধ কাগজ পত্র নাই এবং সরকারি কোন খাজনাও পরিশোধ করে না। তারাই ডেমপিয়ারের বেশীর ভাগ জমি দখল করে আছেন। জমির মালিকগন নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন মহলে দেন দরবার করেও কোন স্থান পায় নায়। ইতিমধ্যে মনপুরা ১নং ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব আবুল কাসেম হাওলাদার ৪২০০/২০১০ হাইকোর্টে আন্তজেলা সীমানা নির্ধারনের জন্য রিট মামলা দায়ের করেন। হাইকোর্ট চর ডেমপিয়ার মনপুরা আর্ন্তগত রেখে আন্তজেলা সীমানা নির্ধারনের জন্য মহাপরিচালক ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়। এছাড়া উচ্চ আদালত চর ডেমপিয়ারকে নোয়াখালী ভূমি ও পুলিশ প্রশাসনের আওতা বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেন।
অপর পক্ষ ২১৪৫/২০১০ লিট-২ আপিল সুর্পিম কোর্টে দায়ের করেন। সূপ্রিমকোর্ট আপিল অগ্রায্য করেন। এবং হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। অতঃপর ২০১৬ সালের শেষে মহাপরিচালক ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের কার্যালয় হতে নোয়াখালী ও ভোলা জেলার সীমানা নির্ধারন করেন। কিন্তু চর ডেমপিয়ারের উত্তর অংশ এখনও অবদি নোয়াখালীর ভূমি দস্যুদের দখলভূক্ত আছে।
চর ডেমপিয়ারের উভ উত্তর ভাগের ভোলা জেলায় ভূমি প্রশাসন বা পুলিশের কোন উপস্থিতি নাই। ফলে এখান থেকে সরকার কোন ভূমি রাজস্ব পায় না এবং ঐ অঞ্চল অপরাধীদের অভয়য়ারন্যে পরিনত হয়েছে। স্বরণযোগ্য যে, ২০০২ সালে নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলায় দক্ষিণাঞ্চলে বিপুল পরিমানে জলসদ্যু ও ভূমিদস্যুর উৎপাত বৃদ্ধি পায়। ফলে সরকার এদের দমনের জন্য আধাসামরিক বাহিনী মোতায়ন করেছিল। সরকারি নজরদারিতে না থাকলে এ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর ডেমপিয়ারের ২০০২ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
সর্বশেষ জরিপের পর যে সিদ্ধান্ত হয়, ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে সরকার বিপুল পরিমান ভূমি কর পেত। এ ব্যাপারে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর এবং সরকারী প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জমির মালিকরা কামনা করছেন।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।