সর্বশেষঃ

প্রাথমিক ধারণা এসি নয়, গ্যাস লাইনে ত্রুটিতেই এ বিস্ফোরণ ॥ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ না দেয়ায় প্রাণ গেল মুসল্লিদের

নারায়নগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণ ॥ দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল ॥ থামছেনা স্বজনদের আহাজারী

কেউ শোকে স্তব্ধ, কেউ চিৎকার করে কাঁদছেন, কারও চোখে জল টলমল। প্রিয়জনের লাশের জন্য অপেক্ষায় কেউ, কারও আবার সংকটাপন্ন স্বজনকে নিয়ে উৎকণ্ঠা। এর মধ্যে স্বামী ইব্রাহিম বিশ্বাসের মৃত্যুর খবর শুনে অচেতন হয়ে পড়লেন নাসরীন আক্তার। আরেক মা বিলাপ করছিলেন তার সাত বছরের ছেলে জুবায়ের ফরাজীর জন্য। টিভি দেখতে থাকা ছোট্ট ছেলেটিকে তিনি একরকম জোর করে স্বামীর সঙ্গে নামাজে পাঠান। ছেলে আর ফিরে আসেনি মায়ের বুকে, স্বামীও সংকটাপন্ন।
এমন অনেক বেদনাবিধুর দৃশ্য দেখা যায় শনিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা এলাকার মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় দগ্ধদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালে। শনিবার রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত সেখানে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসাধীন আছেন ১৬ জন। তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নয়।

এদিকে মসজিদে এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না কেউ। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা নামাজ পড়তে গিয়ে অগ্নিকা-ে দগ্ধ হয়ে পাড়ি জমালেন পরপারে। স্বজনরা বলছেন, কিছু সময় পরই তাদের বাসায় ফেরার কথা ছিল। অনেকে বাসা থেকেই মসজিদে গিয়েছিলেন। আবার কেউ বাইরের কাজ সেরে যান মসজিদে। ফোনে স্বজনকে জানান, নামাজ পড়েই ফিরবেন বাসায়। তাদের আর ফেরা হয়নি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মৃত্যুর পর তাদের ঠাঁই হয়েছে কবরে।
অভিযোগ উঠেছে, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে মসজিদের নিচের গ্যাসের পাইপলাইনে সমস্যার কথা জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ পরিস্থিতিতে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে এসব কমিটি গঠন করা হয়।
অগ্নিকা-ে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি এক শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক এ ঘটনার খবর রাখছেন এবং আহতদের সর্বোচ্চ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শুক্রবার গভীর রাত থেকে শনিবার রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তারা হলেন- মসজিদের মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫), সাব্বির (২২), জুনায়েদ (৭), জামাল (৪০), জুবায়ের (১৪), হুমায়ূন কবির (৭০), মোস্তফা কামাল (৩৪), ইব্রাহিম (৪৩), রিফাত (১৮), জুনায়েদ (১৭), কুদ্দুস বেপারী (৭২), রাশেদ (৩০), জয়নাল (৫০), মাইনুদ্দিন (১২), নয়ন (২৭) কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), মো. রাসেল (৩৪) ও বাহার উদ্দিন (৫৫), মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল মালেক (৬০) ও মিজান (৩৪) সাংবাদিক নাদিম (২০) ।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এখনো ভর্তি আছেন ফরিদ (৫৫), শেখ ফরিদ (২১), মনির (৩০), আবুল বাসার মোল্লা (৫১), শামীম হাসান (৪৫), মো. আলী মাস্টার (৫৫), মো. কেনান (২৪), নজরুল ইসলাম (৫০), রিফাত (১৮), আব্দুল আজিজ (৪০), হান্নান (৫০), আব্দুস সাত্তার (৪০), জুলহাস উদ্দিন (৩০), আমজাদ (৩৭), মামুন (২৩) এবং ইমরান (৩০)।
জানা যায়, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ শেষ হওয়ার পর ঘটে গ্যাস-বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-। এতে মসজিদে নামাজ আদায়রত সবাই দগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।

(মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের একাংশের ছবি)

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা জানান, মসজিদটির নিচ দিয়ে গ্যাস সরবরাহের পাইপ ছিল। সেই পাইপের ছিদ্র থেকে কয়েকদিন ধরেই গ্যাস নির্গত হচ্ছিল। মসজিদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সব জানালা বন্ধ থাকত। এ কারণে গ্যাস বাইরে যেতে পারেনি। এর মধ্যেই শুক্রবার রাতে মসজিদের এসি বা ফ্যানের সুইচ বন্ধ করার সময় সৃষ্ট ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মোহাম্মদ রাসেল নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী শনিবার বার্ন ইনস্টিটিউটে জানান, শুক্রবার মসজিদে মুসল্লির উপস্থিতি ছিল কম। কারণ মসজিদের সামনে পানি জমে থাকায় যাতায়াত কষ্টকর ছিল। তবু তিনি মসজিদে যান। নামাজ পড়ে মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ান। তখনই হঠাৎ বিস্ম্ফোরণের মতো শব্দ ও আগুনের হলকা দেখতে পান। প্রথমে বুঝতে পারেননি কী ঘটেছে। পরে মুসল্লিদের চিৎকার শুনে তিনি ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে যান এবং উদ্ধার তৎপরতা চালান।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ব্যবস্থাপনায় লাশ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যেভাবে চাইবে সেভাবেই লাশ হস্তান্তর করা হবে। স্বজনরা চাইলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হবে। তবে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে ময়নাতদন্ত করা হবে। তিনি আর বলেন, আগুনে মসজিদের ছয়টি এসি বিস্ফোরিত হয়েছে। এতে সব জানালার কাচ ভেঙে যায়। আগুনে সিলিং ফ্যানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে মানুষের রক্ত-মাংস-চামড়া লেগে থাকতে দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাসের উপস্থিতি ছিল জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি হান্নান মিয়া নিজেও এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তিনি কয়েকদিন আগেও তিতাস গ্যাসকে এ লাইন সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিতাস তখন ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ার কারণে লাইন মেরামত বা সংস্কার করেনি। ফলে লিকেজ হয়ে অন্য দিনের মতই গ্যাস জমে যায় মসজিদে। আর গরমের কারণে এসি চালানোর ফলে বাতাস বের হতে না পারায় গ্যাস জমে যায়। আর সেই থেকেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটেছে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর মিয়া বলেন, কয়েকদিন আগেও আমাদের একজন লোক সাঈদ সাহেব তিতাসকে গিয়ে লিকেজের কথা জানায়। তখন তিতাস থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। কিন্তু টাকা যোগাড় করা যায়নি। ফলে আমাদের এত হতাহতের ঘটনা ঘটলো। এদিকে বায়তুল সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে সেই মসজিদে আর আজান বা নামাজ হয়নি।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

You cannot copy content of this page