সর্বশেষঃ

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পর্ব-১

মনপুরায় চাঞ্চল্যকর ব্যাংক এজেন্ট আলাউদ্দিন হত্যাকান্ড ॥ কোর্টে ১০ জনকে আসামী করে স্ত্রীর নতুন মামলা

ভোলার মনপুরায় আলোচিত চাঞ্চল্যকর ডাচ্ বাংলা ব্যাংক এজেন্ট আলাউদ্দিন হত্যার ১১ মাস পরে স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রিতু বাদী হয়ে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মনপুরা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে দশজনকে আসামী করে মামলা করে। মামলায় শ্বশুর মজিবল হক মোল্লা, দেবর জামাল, জাফর, মহসিন, মাইনুদ্দিন, সামসুদ্দিন, প্রতিবেশি শামীম মাষ্টার ও পুরাতন মামলার তিন আসামী জয়নাল, আবু কালাম ও দিবাকরকে আসামী করা হয়। এর আগে গত বছরে ৬ অক্টোবর ব্যাংক এজেন্ট আলাউদ্দিন হত্যার পরদিন ৭ অক্টোবর ভাই জাফর বাদী হয়ে মনপুরা থানায় মামলা করে। ওই মামলায় ৬ জনকে আসামী করা হয়। বর্তমানে ৫ আসামী জামিনে রয়েছে।
এদিকে হত্যার মাস খানেক পর শ্বশুর মজিবল হক মোল্লা মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকা বসত-বাড়ি দেনা পরিশোধের নামে বিক্রি করতে চায়। তখন ব্যাংক এজেন্ট মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী স্বামীর পাওনা-দেনা হিসাব সংগ্রহের জন্য গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, চার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, দুই ইউপি সদস্যদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে ২০২০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারীতে উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, চার ইউপি চেয়ারম্যান, দুই ইউপি সদস্য, বাদী মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী, সন্তান ও বিবাদী শ্বশুর ও দেবরদের উপস্থিতিতে প্রথম শালিসি সভা হয়। এরপর ১ মার্চ ২য় সভা হয়। পরে ২৫ জুলাই দীর্ঘ ৫ মাস সরেজমিনে তদন্ত শেষ করে শালিসদাররা বাদী, বিবাদী ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে তদন্ত প্রতিবেদন দেন।
এদিকে স্বামীর সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ ও হত্যার বিচার চাইতে প্রশাসনসহ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে গেলে ক্ষেপে যান শ্বশুর ও দেবররা। প্রতিবেশী শামীম মাষ্টারের যোগসাজশে দেবররা হত্যা মামলার জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে আলাউদ্দিনের স্ত্রী রিতুকে। এরপর আগস্টের ২৪ ও ৩১ তারিখে পরপর দুইবার মেঝ কণ্যাকে অপহরণ করে চাপ প্রয়োগ করে মামলার নতুন আসামীরা। অপহরনের সংবাদটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হলে নিজেদের নির্দোষ দাবী করতে দেবর ও শামীম মাষ্টার বিজ্ঞাপন আকারে প্রতিবাদ দেয়।

* খুনের রাতেই দোকান ও এজেন্ট ব্যাংকের চাবি নিয়ে যায় দেবর জামাল
* পুরাতন হত্যা মামলা করতে খরচ ৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা
* এজেন্ট ব্যাংকে থাকা ৪০ লক্ষ টাকার হদিস নাই
* খুনের পরদিন এজেন্ট ব্যাংকে থাকা সিসি ক্যামেরা উধাও

হত্যা মামলা করতে খরচ ৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা : চাঞ্চল্যকর আলাউদ্দিন হত্যা মামলা করতে ভাইরা শালিসদারদের সামনে খরচ উপস্থপান করে ৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। খরচে প্রশাসন, উকিল ও সাংবাদিকদের খরচ বাবদ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই খরচ যাচাই করতে গিয়ে শালিসদাররা ৩ লক্ষ ৩২ হাজার টাকার হিসাব পায়। শালিসী প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে হত্যা মামলা করতে এত টাকা খরচ হওয়ায় শালিসদার ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। এই নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে আলোচনার ঝড় উঠে।

হত্যার রাতেই ব্যাংক ও দোকানের চাবি নিয়ে যায় দেবর জামাল : ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত ১২ টায় ফকিরহাট বাজার সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী, বিকাশ এজেন্ট ও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক এজেন্ট আলাউদ্দিনকে বাড়ীর সামনে গলাকেটে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। পুলিশ ব্যাংক ও দোকানের চাবি আলাউদ্দিনের ব্যাগ থেকে পেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু হত্যার রাত সাড়ে ৩ টায় দেবর জামাল ঘরে রক্ষিত থাকা অপর দোকান ও এজেন্ট ব্যাংকের চাবি খোঁজ করে। তখন মৃত আলাউদ্দিনের বড় মেয়ে সুমাইয়া চাচা জামালকে চাবি দেয়। শালিসি বৈঠকে জামাল চাবি নিয়ে যাওয়া বিষয় স্বীকার করে কিন্তু কিজন্য নেয় সেই উত্তর দেয়নি। শালিসি প্রতিবেদন ও রিতু বেগম ও মেয়ে সুমাইয়া সূত্রে এই তথ্য জানা যায়।
এজেন্ট ব্যাংকে থাকা ৪০ লক্ষ টাকার হদিস নাই : শালীসি প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, হত্যার দিন ব্যাংক এজেন্ট আলাউদ্দিনের কাছে নুর আলম মাঝি তার ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে দেওয়ার জন্য ২৯ লক্ষ টাকা দেন। কিন্তু নুর আলম মাঝির একাউন্টটে ৮ লক্ষ টাকা দিতে পারলেও নেটওর্য়াক জটিলতায় ২১ লক্ষ টাকা দিতে পারে নাই। পরে ওই ২১ লক্ষ টাকা নিয়ে যেতে মোবাইলে ফোন করে মৃত আলাউদ্দিন। এছাড়াও অক্তার কেরানীর ১১ লক্ষ টাকা, মাহমুল্লাহ হাজীর ৬ লক্ষ টাকা, ব্যবসায়ী বেল্লালের ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা হত্যার দিন মৃত আলাউদ্দিনের এজেন্ট ব্যাংকে ছিল। ওই চারজনের ৪০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। এছাড়াও স্থানীয়রা বিশ্বাস করে আলাউদ্দিনের কাছে নগদ টাকা আমানত হিসাবে রাখতো। স্থানীয়দের ধারনা টাকার জন্য জেনেবুঝে আলাউদ্দিনকে হত্যা করা হয়।
সিসি ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার গায়েব ঃ আলাউদ্দিনের এজেন্ট ব্যাংক ও দোকানে ৪ টি সচল সিসি ক্যামেরায় ছিল। এছাড়াও একটি ল্যাপটপ ও একটি ডেক্সটপ কম্পিউটার ছিল। হত্যার পরদিন তা উধাও হয়ে যায়। শালিসদার ও স্থানীয়দের ধারনা খুনিরা একে অপরের যোগসাজশে সুকৌশলে আলামত নষ্ট করতে সিসি ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার গায়েব করে ফেলে।
এই ব্যাপারে আলাউদ্দিনের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রিতু বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমার আপনজন দেবরা সহ শামীম মাষ্টার আমার স্বামীকে খুনের পরিকল্পনা করেছে। ওরা টাকার জন্য আমার স্বামীকে খুন করেছে। আমি স্বামীর হত্যার বিচার পাওয়ার জন্য সকলের দ্বারে দ্বারে ছুটে গিয়েছি। পুলিশ, পিবিআই কেউ পাত্তা দেয়না। তাই বাধ্য হয়ে আবার মামলা করেছি। যতই হুমকি আসুক স্বামী হত্যার বিচার না হওয়ায় পর্যন্ত থামবোনা। এদিকে কান্না জড়িত কন্ঠে পিতার হত্যার দাবী করেন বড় মেয়ে সুমাইয়া ও মেঝ মেয়ে আয়শা।
এদিকে শালিসদার উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আক্তার চৌধুরী, জেলা পরিষদের সদস্য একেএম শাহজাহান মিয়া, ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন, ইউপি চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী দীপক, ইউপি চেয়ারম্যান অলি উল্লা কাজল, ইউপি চেয়ারম্যান আমানত উল্লাহ আলমগীর জানান, মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রিতু আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই পক্ষ ও স্থানীয় ব্যক্তি বর্গের উপস্থিতি তদন্ত সাপেক্ষে যা পাওয়া গেছে তার উপর ভিত্তি করে শালিসি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
এই ব্যাপারে মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী রিতুর আইনজীবি এ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির হাওলাদার জানান, মৃত আলাউদ্দিনের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রিতু ১০ জনকে আসামী করে বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করে। পরে বিচারক দীর্ঘ শুনানির পর মনপুরা থানাকে এফআইআর এর নির্দেশ দেয়। এছাড়াও পূর্বে হত্যা মামলা জিআর ৭৩/২০১৯ এর সাথে এই মামলাটির তদন্ত করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।