দ্বীপের আলো
ভোলা জেলার সবচেয়ে পুরাতন বসতি জেলার একমাত্র উপজেলা মনপুরা। এ উপজেলার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্ম নেন বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষস্থানীয় আমলা সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু ভোলায় আসলে যাকে সার্বক্ষণিক সাথে রাখতেন এবং যার বাড়ীতে অবস্থান করতেন সেই মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক মরহুম বশারত উল্লাহ চৌধুরীর ছেলে।
নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পিতা মরহুম বশারত উল্লাহ চৌধুরী ৬০ দশকের প্রথম হতেই দক্ষিণাঞ্চলের খ্যাতিমান সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী ছিলেন। মিল কারখানা, পরিবহন এবং ঠিকাদারী ব্যবসায় তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তিনি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য কর্মী ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে বশারত উল্লাহ চৌধুরী ব্যবসায়ীক কাজে সাতক্ষিরা অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তার নিজের জীপ গাড়ি ও নগদ অর্থ নিয়ে ভারতে চলে যান এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুজিব বাহিনী গঠনে প্রাথমিক পর্যায়ে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৭০ এর নির্বাচনে বশারত উল্লাহ চৌধুরী ভোলা শহরের কালিনাথ রায়ের বাজারস্থ তার নিজ বাড়ী, ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়ী নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হয়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠনের জন্য তিনি ভারতে চলে যান এবং তিনি একজন সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এদিকে পাকিস্তানী সমর্থকরা তার অধিকাংশ সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার সহযোদ্ধা বশারত উল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে মনপুরা উপজেলায় চিন্তা নিবাশ করতে চেয়েছিলেন। মরহুম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধই করেননি, তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দল-মত উর্ধে রেখে বিভিন্ন সংগঠন তৈরী করে ভারতে ট্রেনিং করান এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় যুদ্ধকালীন সময়ে সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে থাকেন।
কি নেই এই পরিবারে। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সচিব, চাকুরে এবং ব্যবসায়ী সবই এই পরিবারে বিদ্যমান। এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চাকুরী, উন্নয়ন এবং সমাজ সেবক হয়ে আলোর দূত হিসেবে আবির্ভূত হন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী।
পাঠক, মনপুরার এই চৌধুরী বাড়ীর মরহুম বশারত উল্লাহ চৌধুরী এবং তার ছেলে নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর কর্মকান্ড এবং সাধারণ মানুষের কিছু অভিব্যক্তি তুলে ধরা হলো।
মরহুম বশারত উল্লাহ চৌধুরী ১৯৫৬ সালে ডেম্পিয়ার এগ্রিকালচার ও ডেইরী ফার্ম লিমিটেড নামে কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। যাহা সরকারের নিবন্ধনকৃত। প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পিতা মরহুম জনাব বশারত উল্লাহ চৌধুরী। মনপুরার ঢালচরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি তে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য তখন হতেই এই কোম্পানী যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও পশু পালন শুরু করেন এবং বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগান।
সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৮৪ সালে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিছুদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, পরে পাবলিক সিভিল সার্ভিসে যোগদেন। পিতার কর্মকান্ডকে বুকে ধারন করে ঢালচরে শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য তার ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে একটি অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল এবং একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। এই অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুলটি মনপুরা উপজেলার প্রাইমারী পরীক্ষায় এবং বৃত্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফলের অধিকারী। উল্লেখ্য যে, ঢালচরে এই স্কুল ব্যতীত আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাই এবং চিকিৎসা কেন্দ্র নাই। তিনি ২০০২ সাল হতে পারিবারিক জমিতেই কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ ও পশুপালন শুরু করেন। সরকারী অনুমতি নিয়েই তিনি এ সকল কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে কৃষিকাজে তার সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ সরকার তাকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক প্রদান করেন এবং তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হতে পদক গ্রহণ করেন। ঢালচরে তিনি উন্নত পদ্ধতির মাছের খামার এবং মহিষের খামার স্থাপন করে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন।
২০০২ সাল হতে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী চাকুরী ক্ষেত্রে চরম হয়রানীর স্বীকার হন। ঘন ঘন বদলী, পদোন্নতি না দেওয়া এবং পোষ্টিং না দেওয়ার মত কার্যক্রম তদানীন্তন সরকার গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি তাকে চাকুরীচ্যুতির নোটিশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করেন এবং জয়লাভ করেন। ২০০৭ সালে তিনি উপসচিব হিসাবে পদোন্নতি পান এবং তাকে পদায়ন করা হয়। ২০০৯ সালের প্রথমদিকে আওয়ামীলীগ সকরার তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালের আগষ্ট মাসে তিনি জ্বালানী বিভাগে বদলী হন। ২০১৫ সালের শেষার্ধে তাকে জ্বালানী বিভাগের সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেন। এর স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার তার চাকুরীর মেয়াদও বর্ধিত করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ স্যূটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সহ- সভাপতি এবং বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে সম্পৃক্ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনপুরার অবসরপ্রাপ্ত এক কলেজ শিক্ষক বলেন, বশারত উল্লাহ চৌধুরীর স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার কথা আমরা মৃত্যু পর্যন্ত মনে রাখবো।
মনপুরার কিংকং পূঁজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শংকর বিজয় বলেন, ঢালচরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। এখানে একটি স্কুল আছে যা গোটা মনপুরা উপজেলার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল। তার কারণে আজ মনপুরাই নয়, ঢালচরবাসী অনেক স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা পাশ করার পর চাকুরীর জন্য নাজিম উদ্দিন চৌধুরী হাত বাড়িয়ে দেন। আমরা তাকে মনপুরার দ্বীপের আলো মনে করি।