করোনাকালে দেশে বেড়েছে পারিবারিক বিরোধ

করোনাকালে দেশে পারিবারিক বিরোধ বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মানসিক চাপ। এতে ঝগড়া, মারামারি, বিবাহবিচ্ছেদসহ নানাবিধ সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এসব সমস্যা যে কেবল গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে, তা নয়। মোবাইল ফোনে বেশি সময় দেওয়া, ফেসবুকিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়া, পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীর রান্না নিয়ে বিরোধ, প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব, প্রেমঘটিত কারণÍএসবই মূলত সহিংসতার কারণ বলে জানা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় পরিবারে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে সময় কাটানোর ফলে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এ থেকে বাদ পড়েনি পরিবারের শিশুসন্তানটিও। বিশ্বে করোনার এই সময়ে নারী নির্যাতন ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায়ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেশি। করোনার সময় পুরুষরা ঘরে থাকছেন। পরিবারের সব সদস্য ঘরে থাকছে। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। তবে আমরা এখনো কোনো তুলনামূলক পরিসংখ্যান পাইনি। এছাড়া এই সময়ে নারীর অভিযোগ জানানোর সুযোগও কমে গেছে। তারা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। আবার স্বামীসহ সবাই ঘরে থাকায় ফোনেও অভিযোগ করতে পারছে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাজিবুল ও সোনিয়া দম্পতির পারিবারিক কলহ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে, তারা শেষ পর্যন্ত আলাদা থাকার পর বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে আসেন। জানা যায়, লকডাউন থেকে তাদের ঝগড়া শুরু হয়। স্বামীর অভিযোগ স্ত্রী কেন ফেসবুকে বেশি সময় দেয়। স্ত্রীর অভিযোগ, স্বামী সারা দিন বাসায়, তাকে কোনো কাজে সাহায্য করেন না। কাজের সহকারী বাসায় বন্ধ, এই সময় স্ত্রীকে ঘরের কাজে সহযোগিতা না করলে একা সোনিয়া সব কাজ করতে পারবেন না। এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়েই তাদের ঝগড়া চরমে ওঠে। এই চিত্র কেবল রাজিবুল-সোনিয়ার সংসারে নয়, এটি এখন অধিকাংশ সংসারের।
সামাজিক অপরাধের চিত্র জানতে চলতি বছর এপ্রিল মাসে এক জরিপ চালিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, গত মে মাসে নির্যাতনের শিকার নারীর মধ্যে ১১ হাজার ২৫ জন অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে। পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৫ শতাংশ নারী, অর্থাত্ চার হাজার ৯৪৭ জন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৩ শতাংশ, অর্থাৎ তিন হাজার ৫৮৯ জন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯ শতাংশ, অর্থাত্ দুই হাজার ৮৫ জন। ২৪টি সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে ২৭ জেলার ৫৮ উপজেলার ৬০২টি গ্রাম ও চারটি সিটি করপোরেশনের ১৭ হাজার ২০৩ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করে সংগঠনটি। জরিপে অংশ নেওয়া এক হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪টি শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি বলে জানান। তবে নারীরা বেশির ভাগই স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এদিকে দেশের ১১টি জেলায় ব্র্যাক পরিচালিত জরিপে ৩২ শতাংশ মানুষ বলেছে, করোনার কারণে কাজ হারিয়ে আয় কমে যাওয়ায় পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। গত ২৬ মার্চ থেকে ৩ জুন পর্যন্ত লকডাউনের মধ্যে রাজধানীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৯৭টি মামলা হয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস জানান, আমরা এক হাজার ৬৭২ জন নারীকে পেয়েছি, যারা আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হননি। এটা প্রমাণ করে যে, করোনার মধ্যে নির্যাতন বেড়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে মানুষের চাকরি তথা রিজিকে হাত পড়েছে। এটা আরো দীর্ঘ হলে সমাজে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়তে পারে। বিশেষ করে অভাবী মানুষের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেলে তারা আয়-রোজগারের জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠলে তাতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।