চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু
বাঙ্গালী জাতির স্বপ্ন পুরুষ, ‘রাজনীতির’ কবি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আজ ৪৫ তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে জীবন দিতে হলো স্বপরিবারে। যে হৃদয়ে বুলেট বিদ্ধ করেছিল ঘাতকরা, সেই হৃদয় ছিল বাঙ্গালীর অন্তপ্রান ভালোবাসার হৃদয়। তিনি বলতেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলবো-আমি বাঙ্গালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার প্রানের দেশ। তিনি তার হৃদয় নিগরানো ভালোবাসা আর ত্যাগ দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে, তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাঙালী জাতি একদিন বিশ্বের দরবারে উন্নত জাতি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে। তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুরা তাকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুরা তাকে শারীরিকভাবে সরিয়ে দিতে পারলেও বাঙ্গালীর হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারে নি। তিনি বাঙ্গালীর হৃদয়ের রাজা, স্বপ্নের পুরুষ, চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বঙ্গে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তার রাজনীতির লক্ষ স্থীর হয়। গোপালগঞ্জ থেকে স্কুল জীবন শেষ করে চলে গেলেন কলকাতা মহানগরীতে। ১৯৪৩সালে ভর্তি হলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে।প্রথমেই উক্ত কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মূলত ১৯৪০সালের সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন প্রদান করায় তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি পরিপূর্ণভাবে রাজনীতিতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।জেলে বসে ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন আওয়ামীলীগের যুগ্ন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং শেরেবাংলা কেবিনেটে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।বাঙ্গালী জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলার মানুষের প্রানের দাবী ৬দফা দাবি উত্থাপন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার ও বিচারের মাধ্যমে প্রহসনের সম্মুখীন, সর্বশেষ ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে মুক্তিলাভ। অবশেষে বাঙ্গালীর অভিসংবাদিত নেতা হিসেবে গনসংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত। ১৯৭০ এর সাধারন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালীর নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন। অবশেষে সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে তালবাহানা ও গড়িমসি। বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, স্বাধীনতার লক্ষে রমনার রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন। ২৫ শে মার্চের কালোরাত্রি ১২:০১ মিনিটে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, তারপরই বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা। ৯ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। ১৯৭২ এর ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ, ১০ই জানুয়ারি মুক্ত শেখ মুজিব স্বাধীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকায় অবতরণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় বাংলার মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ ও ১৯৭২ সালের ১০অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক শান্তির জন্য জুলিওকুরী শান্তি পদকে ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে যোগদান করে বাংলায় ভাষন প্রদান করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূর্ণগঠনের শেষে যখন একের পর এক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই স্বাধীনতার শত্রুরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্ক অধ্যায় রচনা করে জাতিকে পাকিস্তানি শাসনের কায়দায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যতই দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক অজানা অধ্যায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে।
মূলত স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানি শাসক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্যে ষড়যন্ত্র করে আসছিল। ২০শে ডিসেম্বর ১৯৬৯ বঙ্গবন্ধু জানতে পেরেছিলেন তাকে হত্যার জন্য পাকিস্তান থেকে দুজন আততায়ী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে(সূত্র ও তথ্য:- মার্কিন কনসুলেট এর প্রেরিত ওয়াশিংটন ডি সি র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবমুক্তকৃত চিঠি)। এই হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র চক্র রয়েছে। এই হত্যার চক্রান্তের ধারাবাহিতায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধকালীন সময় যুদ্ধে গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যুদ্ধের শেষভাগে পাকিস্তান আর্মিতে মোটিভেটেড ষড়যন্ত্রকারী বাংলাদেশী পাকিস্তান আর্মির সেনা অফিসারদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামীলীগের ভেতরের চক্র খন্দকার মোশতাককে দিয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ইউনিটি বর্জায় রাখার জন্য আপোষরফার ষড়যন্ত্র বানচাল হওয়ার ফলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পারেন বাংলাদেশকে কবজা করে রাখা যাবে না। বাংলাদেশ তাদেরকে ছেড়ে দিতেই হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হবেই। তাই বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিক চাপের কারনে পাকিস্তানি কারাগারে হত্যা করতে না পারার ফলে মুক্ত শেখ মুজিবকে তার নিজ দেশে হত্যা করার এক বিকল্প ষড়যন্ত্রের লক্ষে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশী সেনাবাহিনীর মোটিভেটেড সেনা অফিসারদের কয়েকজনকে যুদ্ধকালীন শেষ সময় পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিশে যাওয়া জন্যে।
উল্লেখ্য যে, সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম দিকেই মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনা করতে। একইভাবে ১৯৭৩ সালের ১১ই জুলাই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কর্নেল রশিদ যে কিনা মেজর ফারুক এর ভায়রা ভাই, তারা দুজনই মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী। তাদের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য পাঠান তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপ প্রধান জিয়াউর রহমান। জিয়াই এই খুনি দ্বয়কে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল নকশাকারীদের প্রথম থেকে ব্যবহার করে আসছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১০ই মে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার জন্য সৈয়দ ফারুক রহমানকে জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে সি আই এ এর কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শের জন্য পাঠান। এর ঠিক ১৫ মাসের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হন। এই বিষয়ে পরবর্তীকালে হত্যাকারী কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ,লেখক সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকারেন হাসের সাথে সাক্ষাতকারে স্বীকার করেন, জিয়া আগস্ট হত্যাকান্ডের মূখ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ, সিভিল, মেলেটারী প্রশাসন ও রক্ষীবাহিনীর কার কি ভূমিকা ছিল আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অফিশিয়ালি হয়নি বলেই জানি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জিয়ার ষড়যন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা আচ করতে পেরে তাকে রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু তা বঙ্গবন্ধুর পাশের কার দূতিয়ালিতে সে সিদ্বান্ত বাতিল হয়ে যায় তা প্রকাশ্যে আশা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অভিনশ্বর। দৈহিকভাবে তিনি না থাকলেও তিনি চিরঞ্জীব। তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে অম্লান। তিনি বাঙ্গালির জাতীয় মর্যাদা, শক্তি, সাহস ও সম্মানের প্রতিক।প্রতিনিয়ত জাতি তার আতœার মাগফেরাত কামনা করে।
লেখক : ফজলুল কাদের মজনু
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামীলীগ।