সর্বশেষঃ

মনপুরায় বিপদসীমার ৯ ও লালমোহনে ১১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত : হুমকির মধ্যে ভোলা শহর রক্ষা বাধ

ভোলায় জোয়ারের পানিতে ২২ গ্রাম প্লাবিত ॥ পানিবন্ধী ১১ হাজার মানুষ ॥ নিখোঁজ-১

পূর্ণিমার প্রভাবে অতি জোয়ারে ভোলার সদর উপজেলা ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরার প্রায় ২২ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে করে পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন ১১ হাজার মানুষ। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। ঘর-বাড়ী হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। শুধু ঘর-বাড়ী নয়, পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। এতে ওইসব ব্যবসায়ীদের কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। হুমকির মধ্যে রয়েছে ভোলা শহর রক্ষা বাধ। এছাড়া জোয়ারের পানিতে গোসল করতে গিয়ে একজন নিখোঁজ রয়েছেন।


সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দিবাগত রাত থেকেই সরাদেশের ন্যায় ভোলাতেও বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। বৃষ্টির সাথে সাথে বইছে দমকা হাওয়া। এই দমকা হাওয়ায় জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বহু গ্রাম। জোয়ারের পনিতে ভোলার সদর উপজেলার শিবপুর, রাজাপুর, পূর্ব ইলিশা, ধনিয়া ও ভেলুমিয়াসহ মোট ১৬টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি পানির উত্তাল জলরাশীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে হাতে গোনা শত স্বপ্ন। বেড়ীবাঁধ এলাকা আবার এমতাবস্থায় তাদের পরিস্থিতি খুবই শঙ্কিত তারা। তারা বলেছেন, এমনিতেই আমরা ঋণগ্রস্ত, এখন আবার এই দূর্যোগ পরিস্থিতি আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অতি জোয়ারের কারণে হুমকির মধ্যে রয়েছে ভোলা শহর রক্ষা বাধ।


স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। জোয়ারের পানির এই তীব্রতা আমরা অনুভব করতে পারিনি। তারা আরও জানায়, আমরা মসজিদে আসরের নামাজ শেষে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি নদীতে পানির পরিমাণ স্বাভাবিক এর চেয়ে পাঁচগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।


এলাকাবাসীরা আরো জানান, আমরা পানির এই তীব্রতা দেখে বাড়িতে ফিরে এসে দেখি আমাদের ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি। তড়িঘড়ি করে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘরের আংশিক আসবাবপত্র সরিয়ে নেই, আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পানিতে ভিজে নষ্ট হ’য়ে গেছে। বিশেষ করে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা উপকরণ, সাটিফিকেট, প্রসংশা পত্র, প্রবেশপত্রসহ দলিল পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদ পানিতে নষ্ট হয়েছে এবং কিছু ¯্রােতে নিয়ে গেছে।


তাঁরা আরও বলেন, আমরা এই বেড়ীবাঁধ এলাকায় হরহামেশাই পানি, বাতাসও দূর্যোগের সময়ে বাচ্চা পোলাপান নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয়। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা ও আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি এবং সরকারের কাছে আমাদের আবেদন যেন আমাদেরকে পূর্বাসনের ব্যবস্থা করে।

এদিকে পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে গোসল করতে নেমে ৩ জন পানিতে তলিয়ে যায়। এদের মধ্যে ২ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ওই এলাকার কাঞ্চনের ছেলে সুজন নামে একজন নিখোঁজ রয়েছে। ইলিশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাছনাইন আহমেদ হাছান মিয়া বলেন, আমাদের ইউনিয়ন কিছু বেড়িবাঁধ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছ।
জোয়ারের ব্যাপারে কাচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম নকিব জানান, তার এলাকার সকল মেম্বার এবং স্থানীয় জনগণকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। তবে, অনেক বাড়ী-ঘর, পুকুর জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে। পানি পুরোপুরি কমে গেলে ক্ষতির পরিমান বুঝা যাবে।

আমাদের নাছির মাঝি সংবাদদাতা জানান, তুলাতুলি থেকে শিবপুরের শেষ পর্যন্ত নদী তীরবর্তী (বেড়ীর বাহিরে) প্রায় ৫শতাধিক পরিবার পনিবন্ধী অবস্থায় রয়েছে। ওইসব এলাকায় দুপুরের দিকে বেড়ী বাধের প্রায় ১ থেকে দেড় ফুট উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বেড়ীর ভিতরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পানি প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরই ভাটার টান থাকায় পানি আবার কমে যায়। যদি ওই সময় জোয়ারের প্রভাব থাকতো তা হলে হয়তো বেড়ীর ভিতরের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়ে হত। দিনের বেলায় জোয়ার উঠলেও তা ভাটার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নায়। কিন্তু রাতের বেলায়ও জোয়ার উঠবে। তখন কি অবস্থা হয় তা নিয়ে ওই এলাকার বাসিন্দারা শংকিত। এদিকে জোয়ারের পানিতে নাছির মাঝি এলাকার বেড়ী বাধের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫শত জিও ব্যাগ দিয়েছেন। এছাড়াও এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্য মাটি কেটে তা বেড়ী বাধের উপরে দিয়েছেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ধনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমদাদ হোসেন কবির।
আমাদের রাজাপুর প্রতিনিধি শফিক খান জানান, জোয়ারের প্রভাবে রাজাপুরের ১, ২, ৪, ৬ ও ৭টি ওয়ার্ডের বেড়ী বাধের বাহিরে (নদীর নীচের দিকে)’র ঘর-বাড়ী পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানকার প্রায় ৭ হাজার মানুষ পানিবন্ধী অবস্থায় রয়েছে। তাদের ভিটে-মাটি এখন পানির নীচে। ওইসব এলাকার লোকজন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এর সাথে কিছু সংখ্যক হাস-মুরগি, গর”-ছাগল নিরাপদ স্থানে আনতে সক্ষম হয়েছেন।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে রামদাসপুর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, এখানকার বজলু হাওলাদার, লোকমান চৌধুরী, আনোয়ার পালোয়ান, মিলন পালোয়ান, সবুজ পালোনায়, মাহাবুব সর্দার, খোকন মাঝিসহ প্রায় শতাধিক লোকের ঘর-বাড়ী জোয়ারের পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনমতে নিরাপদ স্থানে আসতে পেরেছেন তারা। ঘর-বাড়ীর কিছু-ই আনতে পারেননি তারা। সব-কিছু হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। তারা এখন কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু ঘর-বাড়ী নয়, সেখানকার বাজারের প্রায় শতাধিক দোকানও পানিতে তলিয়ে গেছে। সবকিছু হারিয়ে তারাও নিঃস্ব। ছোট-বড় দোকান মিলিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীরা প্রায় কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ক্ষতি তারা কিভাবে পুষিয়ে উঠবেন তা চিন্তার বিষয়। সরকারীভাবে যদি সাহায্য-সহাযোগিতা পান তা হলে তারা কিছুটা হলেও এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন এমনটাই জানিয়েছেন একাধিক ব্যবসায়ীরা।
ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাম মাস্টার বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রচুর পানি উঠেছে, তবে নেমে গেছে। কিন্তু শরিফ খা বাজার, বাঘমারা, ভেলুমিয়া বাজারসহ কয়েকটি জায়গায় রাস্তা প্রচুর পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু’একদিন পরে ক্ষতির পরিমান পুরোপুরি জানা যাবে।
আমাদের ভেদুরিয়া প্রতিনিধি মোঃ হোসেন পাটোয়ারী জানান, জোয়ারের পানিতে অনেক পুকুরসহ বাড়ী-ঘর ডুবে গেছে। ভাটার সাথে পুকুরের মাছ, গরু-ছাগল ভেসে গেছে। পানির চাপে নদী এলাকাগুলো ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। এ সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাজল ইসলাম মাষ্টার।
জোয়ারের পানিতে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা পরির্দশন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিজানুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, ভোলার ১৬ টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইলিশা ও রাজাপুর।


আমাদের মনপুরা প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম মামুন জানান, মনপুরায় পূর্ণিমার প্রভাবে অতি জোয়ারে মূল ভূ-খন্ড সহ নি¤œাঞ্চল ৪-৫ ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষ পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। এদিকে মনপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন কলাতলীর চর ও চরনিজামে ৫-৬ ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও মেঘনার পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পাউবো। সকাল থেকে উপকূল জুড়ে থেমে থেমে ধমকা হাওয়া ও ঝড়ো বৃষ্টি বইছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের দাসেরহাট, সোনারচর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও হাজিরহাটের উপজেলা রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত সহ লঞ্চঘাট এলাকা প্লাবিত হয়। এছাড়াও উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের আলমনগর এলাকা প্লাবিত হয়। মনপুরা ইউনিয়নের নতুন বেড়ীবাঁধের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বির্স্তৃন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।


এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী আবদুর রহমান জানান, মেঘনার পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। এত নিম্নাঞ্চল সহ মূল ভূ-খন্ডের অনেক স্থানে ৩-৪ ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
আমাদের লালমোহন প্রতিনিধি জানান, লালমোহনে জোয়ারের পানির প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভাঙার শঙ্কায় রয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। বুধবার দুপুর থেকে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চাঁদপুর এলাকা ও ধলিগৌরনগর ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। রাতেও যদি জোয়ারের এই প্রভাব থাকে তাহলে এসব স্থান দিয়ে ভেঙে যেতে পারে বেড়ি।


পানিবন্ধি হতে পারে সহস্রাধিক পরিবার। এমনটা দাবী করেছেন স্থানীয়রা। তবে খবর পেয়ে বুধবার সন্ধ্যায় লালমোহনের এসব ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন। এসময় তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর বেড়িবাঁধ সংস্কারের নির্দেশ প্রদান করেছেন।


লালমোহন পওর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সালাউদ্দিন সানি বলেন, বিপদসীমার ১১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে নদীর পানি অতিবাহিত হওয়ায় বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে একপাশ থেকে অন্য পাশে পড়ছে। তবে রাতে জোয়ারের এই প্রভাব থাকবে না। আর যেসব এলাকার কথা বলা হয়েছে তা ভাঙার কোনো সম্ভবনা নেই।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।