করোনায় এবার ২৫ শতাংশ পশু কম বিক্রির শঙ্কা
করোনার মহামারির মন্দায় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়তে যাচ্ছে এবারের কোরবানির ঈদে। পৃথিবীব্যাপী চলা ভয়াল এ মহামারির ছোবল দেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে আঘাত হেনেছে। যার প্রভাবে মানুষের আয় কমে যাওয়াসহ বেকার হয়ে পড়েছে বিশাল সংখ্যক একটি জনগোষ্ঠী। দিন যত যাচ্ছে সেই সংখ্যা আরো বাড়ছে। গত রোজার ঈদের মতো এবারের কোরবানির ঈদেও মন্দার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে গত দুই বছর ধরে পশু বিক্রি হতো প্রায় ১ কোটি ১০ থেকে ১৫ লাখ। করোনা মন্দার ফলে এবার প্রায় ২৫ শতাংশ গরু কম বিক্রি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার ফলে বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ কৃষকশ্রেণিসহ ছোট-বড় বাণিজ্যিক খামারিরা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব মতে এ বছর দেশে কোরবানিযোগ্য গরুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ। প্রতি বছরের মতো এবার গরু কোরবানি হতে পারে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ। গত তিন মাসে করোনার লকডাউন বা চাহিদা কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক গরু বিক্রির হার কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। সেই হিসেবে অবিক্রিত গরুর পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ। এবার কোরবানির হাটের জন্য গরু প্রস্তুত আছে প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ। অ্যাসোসিয়েশন মনে করছে করোনার মন্দার ফলে দেশের মোট কোরবানির সংখ্যা কমতে পারে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। চাহিদার ২৫ শতাংশ কমলে এবার কোরবানিতে গরু বিক্রি হতে পারে ৭০-৭৫ লাখ। সব মিলিয়ে এবার দেশের মোট প্রস্তুতকৃত গরুর প্রায় ৫০ লাখ অবিক্রীত থেকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাছাড় ছাগল বা বেড়ার ক্ষেত্রেও একই হিসাব ধারণা করছেন সংগঠনের নেতারা।
তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এমন হিসাবের সঙ্গে সরাসরি একমত না হলেও মন্দায় গরু বিক্রি কমবে বলে ধারণা তাদের। কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত এ বিশাল সংখ্যক গরু-ছাগল অবিক্রীত থাকলে এবং চাহিদার বিপরীতে জোগান বেশি থাকায় অন্যবারের থেকে এবারের হাটে গরুর দাম পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খামারিরা। এর ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন দেশের সাধারণ কৃষকরা।
ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনের আগে পরে গো-খাদ্যের দাম এত বেশি বেড়েছে যে গরুপ্রতি খরচ আগের থেকেও ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, একটি ১ লাখ টাকা দামের গরু তৈরি করতে অন্য যেকোনো বারের থেকে এবার ১০ হাজার বেশি খরচ হয়েছে গো-খাদ্যের মূল্য বেশি থাকায়। সেই গরু ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিক্রি করতে না পারলে নিশ্চিত লসের মুখে পড়তে হবে। তবে পরিস্থিতি যে রকম দেখছি গরুর দাম এবার সে রকমটা পাব না। ধার দেনার টাকায় গরু প্রস্তুত করে এবার পথে বসা ছাড়া আর কোনো গতি নাই।
জানা যায়, সবচেয়ে বেশি গরু উৎপাদন হয় দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। প্রতি কোরবানের আগে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে গরু সংগ্রহ করে ব্যাপারীরা ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে গরু নিয়ে আসে বিক্রির উদ্দেশ্যে। তাই কোরবানির এক থেকে দুই মাস আগে খামারিদের কাছে গরু কিনতে ভিড় জমাতো ব্যাপারীরা। কিন্তু এবার ব্যাপারীরা গরু সংগ্রহে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। খুলনায় এবার কোরবানিযোগ্য পশু বিক্রি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন প্রায় সাত হাজার খামারি। করোনা পরিস্থিতির কারণে খামারিরা এবার কোরবানির হাটের ওপর ভরসা করতে পারছেন না। অন্য বছরের মতো এবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু কেনায় আগ্রহী ব্যাপারীদেরও খুব একটা দেখা নেই। এছাড়া ক্রেতার অভাবে হাটে নিয়েও গরু বিক্রি করা যাচ্ছে না।
খুলনার মতো একই অবস্থা সিরাজগঞ্জের খামারিদের। এই দুই জেলায় কোরবানি সামনে রেখে গরু নিয়ে চিন্তায় খামারিরা, দেখা নেই ব্যাপারীর। করোনা পরিস্থিতির কারণে জেলা দুটির প্রায় ৪০ হাজার হাজার খামারি ও চাষিরা এবার কোরবানির গরু নিয়ে বিপাকে। খামারিরা বলছেন, কোরবানির আর মাস খানেক সময় আছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার গরু কেনায় আগ্রহী কোনো ব্যাপারীর দেখা নেই। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন গরু পালনকারীরা। তাদের আশঙ্কা এবারের কোরবানির হাটে ক্রেতার অভাবে কম দামে গরু বিক্রি করতে হতে পারে। তাই কোরবানির হাট শুরু হতে সপ্তাহ দেড়েক দেরি থাকলেও গরু পালনকারীরা এখনই তাদের গরু বিক্রির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
পাবনার সাঁথিয়ার অন্যতম গরু খামারি কাশিনাথপুর ইউনিয়নের এদ্রাকপুর গ্রামের সোনাই শেখ। তার খামারে কোরবানির উপযুক্ত ৮টি গরু তৈরি করেছেন। তিনি জানান, অন্যান্য বছরে গরুর ব্যাপারীরা এত দিনে ঢাকার কোরবানির হাটকে সামনে রেখে গরু পালনকারীদের কাছ থেকে গরু কেনা শুরু করে দেন। কিন্তু এবার বেশির ভাগ ব্যাপারী ভয়ে গরু কিনছেন না। তিনি বলেন, করোনার কারণে হাটে গরুর দাম কেমন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণেই ব্যাপারীরা গরু কিনছেন না।
ফরিদপুর উপজেলা খামার মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তার খামারে এবার দশটি কোরবানিযোগ্য গরু আছে। এ দিকে খাবারের দাম বেশি।’ তিনি বলেন, ‘সয়াবিন বস্তা (৩০ কেজি) ৯০০ টাকা, এক মণ ভুসি ১ হাজার ৬০০ টাকা, চালের কুড়ার বস্তা (৫০ কেজি) ৭০০ টাকা, ভুট্টার বস্তা (২০ কেজি) ৬০০ টাকা। গরুর ন্যায্যমূল্য যদি এ অবস্থায় না হয় তাহলে বড় রকমের লোকসান হবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গরু বিক্রি হয়। অন্যান্য বছরে রমজান ও ঈদুল ফিতর মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ গরু বেচা-কেনা হয়। সেখানে করোনার কারণে এ বছর বেচা-কেনা হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন লাখের মতো। এই অবিক্রীত গরু এবার কোরবানির পশুর সঙ্গে যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে গত তিন মাসে প্রায় ১২ লাখ গরু উদ্বৃত্ত রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার বিক্রি ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ কম হতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা। এতে অনেক খামারি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) এ কে এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর কোরবানিযোগ্য পশুর যে জোগান রয়েছে তা চাহিদার চেয়ে বেশি হবে বলেই আশা করছি। আমরা পশু বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। করোনার কারণে পশুর হাটের সংখ্যা বেশি করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে সামাজিক দূরত্ব মানা যায়।
বাংলাদেশ মাংস বিক্রেতা সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, করোনায় আর্থিক মন্দার ভেতর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। যে ব্যক্তি দুই লাখ টাকার গরু কিনত সে এবার এক লাখ টাকার গরু খুঁজবে। যে দুটি কিনত সে একটা কিনবে। অনেকে হয়তো কোরবানিই দেবেন না। এবার রমজান ও ঈদুল ফিতরেও গরু ও মাংস বিক্রি অনেক কম হয়েছে।