সর্বশেষঃ

প্রেক্ষিত বিশ্ব স্বাস্থ্য ও বাংলাদেশ

কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস এর বিশ্বব্যাপি প্রকোট ও মৃত্যুহার ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ও পর্যালোচনা বিশ্ব পরিসরে শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর ব্যর্থতার জন্য অর্থায়ন বন্ধ ঘোষণা করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ব এর কোন এক দেশে কোন সংক্রমন দেখা দিলে বা ছড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে তা আমলে নিয়ে এর উৎস ও বৈশিষ্ট এবং ব্যাপ্তি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করবে তা নিয়ে আগাম সতর্ক বার্তা দেয়ার কথা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্ব-স্ব দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী ছিল।
আমরা জানি প্রাচীন কাল থেকে মাধ্যযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল এর ভিতর চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এর নজির ছিল। ভারতীয়, আরব, গ্রিক অঞ্চলে বিকশিত চিকিৎসা শাস্ত্রের পারস্পরিক যোগাযোগ মত বিনিময় হয়েছে সেই সময়। উনবিংশ শতাব্দির দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখি যে, সে সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি তাদের ঔপনিবেশ এর ভিতরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক ব্যাপক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। মুলত ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিকশিত মেডিকেল শাস্ত্র ক্রমেই ঔপনিবেশিক এর সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ঐ সময় ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔপনিবেশ গুলির রোগতত্ত্বের উপর গবেষণার জন্য নানা প্রতিষ্ঠান চালু করে। ট্রপিকাল মেডিসিন এর উপর নতুন বিভাগ চালু করে তারা। ব্রিটেন লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিকাল মেডিসিন, হল্যান্ড রয়েল ট্রপিকাল ইনস্টিটিউট এখনো তাদের সেই ঐতিহ্যপূর্ণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপনিবেশিক কাল পর্বে মোটা দাগে বললে এই সবই ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্যের কর্মকান্ড। বিশ শতকের ১৯৪০ এর দশকে উপনিবেশিক দেশগুলি এক এক করে স্বাধীন হতে থাকে। সদ্য স্বাধীন দেশ গুলিতে হাসপাতাল কেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাই অব্যাহৃত আছে এবং স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর জোর কম থাকে। ৬০’র দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য ভাবনার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এসব আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বিশেষ রোগ প্রতিরোধ এবং রোগ নির্মূল এর উদ্যোগ নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ স্মল ফক্স বা গুটি বসন্ত এবং ম্যালেরিয়া নির্মূল এর ব্যবস্থা নেয়া হয়। যার সফলতা আমরা লক্ষ্য করি। বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল এর জন্য এখনো ইপিআই কর্মসূচী চালু আছে। যা ইতিমধ্যে সফলতা পেয়েছে।
১৯৭৮ সালে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাকস্থানের আমলা আটা শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গৃহিত ঘোষণা। এটি আলবা আটা ডিক্সারেশন নামে পরিচিত। এই ঘোষণার প্রাথমিক জন স্বাস্থ্য সেবাকে নিশ্চিত করার উপায় নির্ধারণ করা হয়। শুধু হাসপাতাল কেন্দ্রিক এবং ডা: পরিচালিত চিকিৎসা সেবা গুরুত্ব প্রদান করা হয় গ্রামিন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কর্মী তৈরী করার উপর। পৃথিবীর বহু দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নানা কর্মসূচী গ্রহণ করে। যেমন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গৃহিত কর্মসূচী কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প।
১৯৮০ সালে পুনরায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতিমালা ঘোষণা করে। এই লক্ষ্যে নানা কর্মসূচী নেয়া হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমগ্র পৃথিবীতে বিশাল জনসংখ্যা রোগতত্ত্বগত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর জীবন যাপন, বিশ্বায়ন ইত্যাগির ব্যাপক প্রসারতায় জীবন যাত্রার, খাদ্যাবাসে, বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাহিদার ব্যাপকতর পরিবর্তন এর কারণে সৃষ্টি শারিরিক রোগ বালাই, উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশের বিভিন্ন প্রকার সংক্রামক রোগ বালাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য আজ একটা বড় হুমকি। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয়, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদির কারণে প্রতিনিয়তই মানুষের স্বাস্থ্যের উপর, জীবনের উপর নতুন নতুন সংকট নেমে আসছে। এসব সংকট মোকাবেলা আজ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সংকট রাষ্ট্রের একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে করোনা সংকট মোকাবেলায় ভেকসিন তৈরীর জন্য সকল খরচ বহন করার ব্যাপারে বিল এন্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এগিয়ে এসেছে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংক্ষেপে স্বাস্থ্য খাতের উপর কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিচু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের গৃহিত নানাবিধ কর্মসূচী নেয়ার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, মৃত্যু হার কমেছে, কমেছে মাতৃ মৃত্যুর হার ও শিশু মৃত্যুর হার। এটা জনস্বাস্থ্য সুচকে সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন বলা যায়। শিশু মৃত্যু হার রোধে সাফল্য এর জন্য প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়ার জন্য প্রতি ৬ হাজার লোকের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক করার পক্ষে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেছেন। দেশের হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা ৭ হাজার বৃদ্ধি করা হয়। প্রথম বারের মত একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার পাশাপশি প্রতিষ্ঠা করা হয় কিডনী, ক্যানসার, নিউরোলজি সহ চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট সহ বেশ কয়েখটি বিশেশায়িত হাসপাতাল ও ইনষ্টিটিউট। স্বাস্থ্য খাতে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য হিসাবে ২০০০ সালে এষড়নধষ অষষরধহপব ভড়ৎ াধপপরহব ধহফ রসসঁহর ৩ ধপঃরড়হ (এঐঠও) অধিৎফ পায় বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য এর জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে গরষষরহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং অধিৎফ প্রদান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা সরকার ৩টি নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সহ ১০৭টি সরকারী, বে-সরকারী মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ একটি পোষ্ট গ্রাজুয়েট নার্সিং ইনষ্টিটিউট, ১৬টি ইনষ্টিটিউট অব হেলথ্ টেকনলজি স্থাপন করা হয়েছে। একটি আধুনিক বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারী ইনস্টিটিউট স্থাপন। ইনষ্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স, ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব ই.এন.টি স্থাপন উল্লেখযোগ্য। এই সাফল্যগুলি মানুষ এর সেবায় উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলেই স্বাস্থ্য সেবায় বাংলাদেশ বিশ্বে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পৌছতে পারবে। বাংলাদেশের এই স্বাস্থ্য চিত্র থেকে আমরা আবার ফিরে যেতে পারি বিশ্ব স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে।
বিশেষভাবে স্মরণ যোগ্য এই যে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যে কোন দেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকল্পনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্যের যে নানা শর্ত উল্লেখ করা আছে। সে দিকে নজর প্রদান করা প্রয়োজন। বিবেচনায় রাখা দরকার একটি দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রশাসন এর সঙ্গে যুক্ত। কাজেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় রোগতত্ব বিষয়ে গবেষণা কর্মী নিয়োগ ও উচ্চতর গবেষণার জন্য স্কলার নিয়োগ এর সুবিধা সুযোগ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাখতে হবে। যাতে করে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের গবেষণালব্ধ বিষয়গুলি জনগণের সেবার জন্য কাজে লাগাতে পারি।

লেখক : ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামীলীগ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।