ডেটলাইন ভোলার চর চটকিমারা : পর্ব-১

হজরত আলীর প্রতারণায় সর্বশান্ত ভেদুরিয়ার চর-চটকিমারার ৩৫ পরিবার ॥ শালিশ মিমাংশায়ও মিলছেনা কোন প্রতিকার

(হজরত আলী বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। ইনসেটে প্রতারক হজরত আলী)

নাম তার হজরত আলী। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। থাকেন ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের পৌর কাঠালী এলাকায়। যদিও তিনি একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু এই ব্যবসার পাশাপাশি তিনি প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় অর্থ কোটি টাকা। প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ হচ্ছে তার প্রতারণার শিকার। এমনই প্রতারণার জাল ফেলেছেন ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চর চটকিমারা এলাকায়। সেখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে করে যাচ্ছে প্রতারণা। সহজ-সরল ঐ সকল মানুষদের সরকারের কাছ থেকে জমি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে নানান ভাবে বোঝাতে থাকেন। গ্রামের ওই সহজ সরল মানুষগুলো তার কথায় বিশ্বাস করে নিজেরা একটু ভালোভাবে থাকতে পারেন তার জন্য জনপ্রতি বিভিন্ন দাগে এবং বিভিন্ন অংকে টাকা দেন। টাকা নিয়ে হজরত আলী ওই সকল মানুষদের সাথে করতে থাকেন প্রতারণা। তার এই প্রতারণায় মোটা অংকের অর্থ হারিয়ে সর্বশান্ত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। ওইসব ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে হজরত আলীর প্রতারণা-অনিয়মসহ নানা কাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নে দীর্ঘ ৪০ বছর আগে এই চরটি জাগে। চর চটকিমারা এলাকাটি চর পড়ারর সাথে সাথে সেখানে কৃষকরা বসবাস শুরু করে। সেখানে যাদের সামান্য পরিমানে জমি ছিল তা নিয়ে তারা কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবন-জিবিকা পরিচালিত করছে। আর ওই চরে যাদের একটু বেশি জমি রয়েছে তারা সেখানকার হর্তা-কর্তা বনে যান। তারা যেভাবে কথা বলেন সেভাবেই অসহায় কৃষক-শ্রমিক লোকেরা শুনতে বাধ্য হচ্ছে অসহায় হয়ে। তাদের এই অসহায়ত্বকে পুজি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার লালশায় নামেন কিছু লোক। তাদের মধ্যে একজন হলেন হজরত আলী। তিনি যদিও বা ভোলার আলীনগর ইউনিয়নে থাকেন, কিন্তু সেখানে তার ২শত ৮ শতাংশ জমি রয়েছে। আর সেই জমি ভোগ-দখল ও দেখভাল করার পাশাপাশি তিনি খবরদারী করে বেড়ান চর চটকিমারায়। ওই চরের সরল মনা মানুষকে নিয়ে মেতে উঠেন ছেলে খেলায়। তিনি ওই চরের মানুষদেরকে কিছু সরকারী জমি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে একাধিক লোকের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে সর্বমোট প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এমন হাজারো অভিযোগ রয়েছে। টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন তিনি ওইসব লোকদেরকে জমি দেই, দিচ্ছি বলে কাল ক্ষেপন করছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, টাকা নিয়ে হজরত আলী এখন আর ওই চরে তেমন একটা যান না। যদিও বা যান তা আবার লোক চক্ষুর আড়ালে চলে আসেন ভোলায়। আর ওখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা প্রতিদিন তাকে কাছে পান না, তাই তার কাছ থেকে টাকা কিংবা জমি দেয়ার কথা থাকলেও সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাও করতে পারেন না। আর যদিও বা দেখা পান, তখন তিনি তাদেরকে বিভিন্ন তাল-বাহানার মাধ্যমে পাশ কাটিয়ে চলে আসেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার খেটে খাওয়া মানুষরা স্থানীয়ভাবে একাধিকবার শালিস মিমাংসায় বসার চেষ্টা করেও কোন প্রতিকার পান নি। পাবেন-ই বা কিভাবে ? তাদের তো আর অত বেশি টাকা-করি নাই, লোকবল নাই, ক্ষমতাও নাই। হজরত আলীর টাকা-পয়সা আর ক্ষমতার কাছে সাধারণ মানুষরা আজ নিষ্পেশিত।
সূত্রে আরো জানা গেছে, ওই চরের সাধারণ মানুষগুলো গত ২০/০৩/২০২০ ইং তারিখে হজরত আলীর গ্রামের বাড়ী শিবপুরের ৯নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ রতনপুরের পাটোয়ারী বাড়ীতে আসে তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য। কিন্তু এখানে এসেও কোন ফল পান নি তারা। উল্টো ওই সকল লোকদেরকে বিভিন্ন প্রকার গাল-মন্দ এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেন। উপায়ন্তর না পেয়ে ভোলা সদর মডেল থানায় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে আবদুল মালেক বাদী হয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
ওই লিখিত অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, বিগত ২০১৬ সালে হজরত আলী তার চর চটকিমারা জমি বিক্রির ব্যাপারে স্থানীয় মোঃ নুরনবী (৬০), আনোয়ার ডাক্তার (৫০), বাবুল মাল (৩৫), রাকিব মাল (২৫), রশিদ চৌকিদার (৫৫), তছির আহাম্মদ (৬৫), মোঃ ফারুক (২৫), মোঃ শাহে আলম (৪৭) ও মোঃ হেলাল (৩৩) এর কাছে মত প্রকাশ করেন। উপরোল্লিখিত লোকজন হজরত আলীর কথায় বিশ্বাস করে প্রতি গন্ডা জমির মুল্য ৪০ হাজার টাকা নির্ধান করে ২ একর জমিতে হজরত আলীকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার কথা হয়। ওই কথার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময়ে ভুক্তভোগী লোকজনের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেন হজরত আলী। জমি রেজিষ্ট্রি করে দেয়ার কথা বললে, হজরত আলী তার জমির কাগজপত্রে কিছুটা জটিলতা আছে এমন কথা বলে তাদের কাছ থেকে কিছু দিনের সময় নেন। আর জমির দলিল রেজিষ্ট্রি করিয়ে দেই দিচ্ছি বলে সাধারণ মানুষদেরকে ঘুরাইতে থাকেন। এমন পরিস্থিতি ভোলা সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ এবং স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদেরকে বিষয়টি অবহিত করেন। তখন হজরত আলী ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি কি ওদেরকে ভয় পাই এমন কথা বলেন। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগী এবং হজরত আলী ও তার ভাই মোঃ শাহিন এর সাথে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। ভুক্তভোগী আবদুল মালেককে মারধর করতে এগিয়ে আসেন তারা। এসময় মালেকের ডাক-চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে এবং কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে ভুক্তভোগী মালেকসহ সকলে বিষয়টি খুলে বলেন। তখন হজরত আলী ভুক্তভোগীতের কাছ থেকে জমি দিবে বলে যে ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন তা অস্বীকার করেন।
ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আলী বলেন, চর চটকিমারায় ৬২ শতাংশ জমির উপর একটি প্রাইমারি স্কুল হয়েছে। ওই ৬২ শতাংশ জমির মধ্যে আমার ছিল ১৬ শতাংশ। হজরত আলী আমার কাছ থেকে জোড়পূর্বক ওই জমি নিয়ে যায়। তখন তিনি আমাকে অন্যত্র জমি দিবেন বলেন, কিন্তু দীর্ঘ ১৫/২০ বছর যাবত দেই-দিছ্ছি বলে আমাকে ঘুরাইতে থাকেন। কিন্তু জমি দেন না।
অপর ভুক্তভোগী সেফালী বেগম বলেন, হজরত আলীর জমির পাশে আমার বাড়ীটি অবস্থিত। আমার এই জমিটি হাতিয়ে নেয়ার জন্য লাঠিয়াল দিয়ে হামলা চালায়। এতে আমার মেয়ের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। জমি না নিতে পেরে হজরত আলী আমার স্বামীর বিরুদ্ধে লালমোহনের একটি নারী নির্যাতন মামলায় জড়িয়ে ৬২ দিন জেল খাটান। এতে আমার অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। আমি এই জমি খেকো ভূমিদস্যু ও প্রতারক হজরত আলীর ঠিক বিচার চাই।
ইউসুফ নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, হজরত আলী আমাকে ১ একর জমি দিবে বলে আমার কাছ থেকে বায়না বাবদ ১৭ হাজার টাকা নিয়েছে। আজ ৩ বছর আমাকে জমিও দেয় নাই, টাকাও দেয় নাই। আমি এই প্রতারকের বিচার চাই।
ভুক্তভোগী দুলাল জানান, প্রতারক হজরত আলী ১৮ বছর আগে ৫ গন্ডা জমি দিবে বলে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে, কিন্তু দলিলে লেখা আছে ৬ হাজার টাকা। ওই জায়গাও তিনি দুর্নীতি করেছে। জমি না দিয়ে তিনি উল্টো আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এতে আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি আমাকে জমি বুঝিয়ে দেয় নাই। আমি আমার জমি পেতে চাই এবং এই ধান্দাবাজ ও প্রতারকে বিচার চাই।
ভুক্তভোগী আব্দুল মালেক জানান, ২০১৫ সালে আমাকে ৩৪ শতাং জমি দিবে বলে বায়না বাবদ ৩০ হাজার টাকা নেয়। ৩৪ শতাংশ জমির দাম আসে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু বিভিন্ন মেয়াদে জমি আরো বেশি দিবে বলে হজরত আলী আমার কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা নিছে। কিন্তু এখনও তিনি আমাকে জমি বুঝিয়ে দেন নাই অথবা টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।
এ ব্যপারে অভিযুুক্ত হজরত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটি গ্রুপ ওই সকল লোকদেরকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে রটাচ্ছে। আপনার বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যারা থানায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে তাদের সাথে বসে একটি সমাধা করা হবে বলে জানান তিনি।
লিখিত ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভোলা সদর থানার এএসআই আরিফকে দায়িত্ব দেয়া হয় ঘটনার তদন্ত করার জন্য। তিনি জুন মাসের প্রথম দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে এসেছেন। কিন্তু তদন্ত করে কি পেলেন এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে আরিফ বলেন, আমি তদন্ত করে এসেছি এবং তা আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি। আগামী ৩ জুলাই তারিখে হজরত আলী সহ ভুক্তভোগীদের নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে উভয় পক্ষের কথা শুনে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

প্রিয় পাঠক হজরত আলীর আরো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরবো তার রাম রাজত্যে ও দুর্নীতির দ্বিতীয় পর্ব। এ খবর পেতে চোখ রাখুন দৈনিক ভোলার বাণীতে।

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।