সর্বশেষঃ

জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-১৫

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

(গত সংখ্যার পর), ছিন্নমূল পরিবারে বিচিত্র লোকালয় দৌলখান, ভোলা : ভোলা জেলার আটশত বছরের ইতিহাসে ভোলার মূল রূপরেখার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দৌলতখান ছিল ভোলার মূল প্রাণকেন্দ্র প্রথমে ভোলা মোগল শাসনামলে একটি পরগনার নব দ্বীপ (চরাঞ্চল) ছিল। এরপর মহকুমায় রূপান্তরিত হয়েছে। তখন সৃষ্টিলগ্ন থেকে ভোলা দৌলতখান কেন্দ্রিক পরিচালিত হতো।

ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস ছিল এক সময় ভোলার নিত্য সহচর। মগ, পর্তুগীজদের নির্যাতন মানুষকে অসহায় করে তুলেছিল। তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগও ছিল ভয়াবহ শংকটাপন্ন। ভোলা জেলার প্রায় আড়াইশত কিলোমিটার দীর্ঘ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বেড়িবাঁধের উপকূলে বসবাসরত অসহায় দরিদ্র, নিপীড়িত লক্ষাধিক মানুষ এক বিচিত্র জীবন গড়ে তুলেছিল। এদের ৯০% অর্থাৎ শতকরা ৯০ ভাগ লোকই দরিদ্র্য সীশার নিচে বাস করে। দশ ভাগ পরিবার ছিন্নমূল পরিবারের ছদ্মবরণে বাড়ী-ঘর তুলিয়া দখল অবস্থানে আছে।

১৯৭২ সালে নদী ভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত পরিবারগুলি প্রথম আশ্রয় নেওয়া শুরু করে এবং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২২ বছর আশ্রয় গ্রহণকারী লোকজনের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। এদের পুনর্বাসনের জন্য আশানুরুপ উদ্যোগ গ্রহন করা হয় নি। ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও তজুমুদ্দিন থানার মেঘনা, তেঁতুলিয়ার কোল ঘেষে বিশাল বেড়িবাঁধ ও ঢালের নীচে সারি সারি ঝুপড়ি, আধাপাকা টিনের ঘর ও প্রচুর গাছ-গাছালি ছিল। তারা অসহায় মানবেতর জীবন-যাপন করত। বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ছিন্নমূল পরিবারগুলি কেনাকাটার জন্য হাট-বাজার বসাত। ছোট ছোট ঘর তুলে দোকান তৈরী করে নতুন নতুন লোকালয়ের সৃষ্টি করে পরবর্তীতে হাট-বাজারের নামকরণ করা হতো। তাদের ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশই ছিল শিশু শ্রমিক। তারা বাল্যবিবাহে জড়িয়ে পড়ত। সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার মত পরিবেশ তখন ছিল না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতায় লেখা-পড়ার কোন গুরুত্ব তাদের নিকট ছিল না। সন্ধ্যা হলে তাড়াহুড়া করে ডাল-ভাত যা সাধ্য ছিল, তা খেয়ৈ সকলে মিলে ঘুমিয়ে পড়ত। ছোট ছোট মেয়েরা শাড়ী পড়ত। নাকে, কানে, হাতে তৎকালীন গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী অলংকার ব্যবহার করত। যা বর্তমানে হাসি রহস্যে ভরপুর। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা এর উপকারিতা ও অপকারিতার কোন কিছু তারা বুঝত না।

বর্তমানে ভোলা আধুনিকতার ছোয়ায় অনেকাংশ এগিয়ে আছে। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে অনেক আবাসন তৈরী করে অনেক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ করে শিক্ষা-দিক্ষায় ভোলা জেলা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভাল অবস্থানে আছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কোন দল ক্ষমতায় গেলে ভোলার রাজনৈতিক নেতারা উচ্চপদস্থ মন্ত্রীত্ব পান। এটা ভোলার জন্য একটা গৌরব। তবে দুঃখের সাথে বলতে হয় ভোলার প্রবীণ নেতা মোশারফ হোসেন শাজাহান, নাজিউর রহমান মঞ্জু ইন্তেকাল করে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

মেঘনা নদীর ভাঙ্গন জনিত কারণে ভোলার মূল প্রাণ কেন্দ্র ও পুরাতন ঐতিহ্য আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে। পুরাতন জমিদারী বিলীন হয়ে বর্তমানে ছিন্নমূল পরিবারের বিচিত্র লোকালয়ে পরিণত হয়েছে। আমার পিতৃ ও মাতৃক, পরিবারে অতীত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দৌলতখানে। যদিও কালের কপোলতলে সেই স্মৃতি দোলা দেয় আমার মনে। আমি হারিয়ে যাই কালের কপোতলে। হে অনাদি হে অনন্ত সদা জাগ্রত হও, চির অপর থাক।

 

(চলবে————-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।