জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৯

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

(গত সংখ্যার পর), ইতিমধ্যে ২৩শে মার্চ অর্ডার পেলাম, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দিতে হবে। বেছে বেছে দু”শ মেয়ে নিয়ে সেই বিশাল রাস্তা ধরে হাতে ত্রিশটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে সামনে কমান্ড করে চললাম। মানিক মিয়া এভিনিউতে ভীড় থাকা সত্ত্বেও লোকজন সামনে আমাদের পথ ছেড়ে দিল। আমরা পৌছে বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট লেনটাতে দাড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু আসলেন, আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বঙ্গবন্ধু।

আমি মেয়েদের কমান্ড করে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দিলাম এবং হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়ালাম। তিনি হ্যান্ডসেকের পরিবর্তে আমাদের সালাম জানালেন। আমি মুদ্ধ হলাম। সেদিন কোন সেলুটিং ব্যাজ ছিল না। ফুলের টব ছিল না, ন্যাশনাল ফ্লাগ ছিল না, কোন ব্যান্ড বিউগলের সুর বাজছিল না। শুধু বঙ্গবন্ধু আর আমি। এই প্রথম আমার জীবনের স্মৃতিপটে আঁকা থাকবে। এই গার্ড অব অনারের দৃশ্যগুলো টিভিতে দেখানো হয়েছিল।

তারপর ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাক বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ল নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর। ঘরবাড়ী থেকৈ নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতে আরম্ভ করে পরে তাদের হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। পাক বাহিনীর এই হত্যা, অকথ্য নির্যাতন, লুটপাট আর অগ্নি সংযোগের ঘটনায় সারা বিশ্বের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। সারা দেশ যেন একটা নিথর কবরস্থানে পরিনত হ। প্রায় ১ কোটি মানুষ সীমান্ত পার হয়ে পাশ্র্ববর্তী ভারতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

পাকিস্তানী বাহিনীর ২৫শে মার্চের এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এমন কিছু একটা ঘটতে পারে ভেবে বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদেরকে স্বাধীনতা ঘোষণার ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন। যার কারণে ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা দেশ জুড়ে শোনা যায়। ফলে হতবিহ্বল বাঙ্গালী জাতি নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তাই দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে সাথে সারা বাংলাদেশে। বাঙ্গালীর মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর আমি ভোলায় চলে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার স্বামী-সন্তানদের মুখ থমথমে। আমার বাবা এসে বললেন, ঢাকায় যা করেছিস, ভাল করেছিস। এখন আল্লাহ আল্লাহ কর। কিন্তু আমি কারো কথা শুনলাম না। না বাবার আদেশ, না স্বামীর উপদেশ। এখানে এক উকিলের বাসায় সব মেয়েদের একত্র করে রাইফেল ট্রেনিং এবং যুদ্ধ প্রতিহত করার কৌশল শিখাতে লাগলাম। কারণ তখন আমার কানে ছিল শুধু বঙ্গবন্ধুর কথা, আর সব ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আমার জীবনের কথা আর আমার এগার সন্তারের কথাও চিন্তা করলাম না শুধু দেখের জন্য।

এদিকে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ ছাত্র-শ্রমিক, কৃষক ও বুদ্ধজীবী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন এবং নিজেদের হাতে অকুতোভয়ে অস্ত্র তুলে নেন। কেউ কেউ পাশ্র্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে কেউ আবার দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে ট্রেনিং গ্রহণ করে।

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সারাদেশে এক যোগে মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর উপর আক্রমন চলায়। ডিসেম্বর পাক বাহিনী ভারত ও আক্রমন করলে পরে ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে চলে। এরই মধ্যে পরাজয় অবধারিত দেখে পাকবাহিনী শেষবারের মত এ দেশকে দুর্বল করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। তাদের এই কাজে দেশীয় কিছু লোক সাহায্য সহযোগিতা করে। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, শহিদুল্লাহ কায়সার, ডা. ফজলে রাব্বি, জহির রায়হান সহ আরো অনেক বীর সন্তানরা প্রাণ হারায়। যাদের চরণধূলোয় ধন্য ছিল এ দেশ, তাদের পাক বাহিনী হত্যা করে এ দেশকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়।

 

(চলবে————-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।