জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৩
ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),
(গত সংখ্যার পর) আজ আমার মনে পড়ে বিস্মৃতির অতল থেকে সেই ২৩ মার্চের কথা। আমার সাথে ৩০ জন রাইফেল হাতে ধরা মেয়ে। আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ছোট লেনটাতে ঢুকে পড়লাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এলে আমি স্যালুট করে হ্যান্ডসেফের জন্য হাত বাড়ালাম। কিন্তু তিনি হ্যান্ডসেফ না করে শুধু সালাম দিলেন। এই প্রথম আমি কোন খাটি বাঙ্গালীকে স্যালুট করলাম।
এদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমার কর্মকান্ড জানতে পরে আমাকে খুজতে লাগল। এসব খবর পেয়ে আমি সন্তান-স্বামী নিয়ে পালিয়ে বেড়ালাম। কত কষ্টের ছিল আমার সেদিনগুলো। এমনিত অনেক সময় কেটেছে যখন আমি স্বামী-সন্তান, সংসার, বাবা-মা পুরো পরিবার ছেড়ে এখানে সেখানে ঘুুরে বেড়িয়েছি, আত্মরক্ষার জন্য। আমার যুদ্ধকালীন সেই কার্য সার্থক বলে মনে হল তখন যখন দেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে পেলাম। দেশ স্বাধীন হবার পর আমার নেতা, বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম।তিনি খুব খুমি হয়েছিলেন।
আমার বয়ষ এখন ৮৫। এই বয়সে এক মুহুর্তের জন্য আমি থেমে নেই। যে কোন সভা-সমিতিতে যখন আমাকে অনুরোধ করা হয় কবিতা আবৃত্তির জন্য তখন আমি না করি না। এখনও আমি এক নাগাড়ে অনেকগুলো কবিতা মুখস্ত বলে দিতে পারি। কোন সালে কোন পত্রিকায় কখন কোন কবিতা ছাপা হয়েছিল তাও বলতে পারি। কিন্তু, এনিয়ে আমার কোন অহংকার নেই যা আছে তা হল সন্তুষ্টি আর আত্মতৃপ্তি।
আমার সারাটা জীবন কেটেছে দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে করতে । নিজের জন্য সময় দিয়েছি খুব কম। ভেবেছিলাম নিজ দেশে এর মূল্যায়ন হবে আশানুরুপভাবে কিন্তু তা হয়নি। বরং অন্য রাষ্ট্র আমেরিকাতেই শেষ পর্যন্ত আমার মূল্যায়ন হল। ২০০৬ সালের ৭ই মে সেখানকার “সিয়েনা হাইট ইউনিভার্সিটি” (SIENA HEIGHT UNIVERSITY) থেকে আমাকে পি. এইচ. ডি ডিগ্রী দেওয়া হয়েছে। মানবতার জন্য আমাকে এত বড় সম্মান দেওয়া হল। এই সম্মান (Humane Letters) আমাকে অর্জন করতে হয়েছে ৬৪ বছর সাধনার পর। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন সবচেয়ে বড় স্মরণীয় মুহুর্ত এটিই। এই আনন্দ এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের নয়।
যদি অবসরের কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে তো উত্তরে তাদের হতাশই হতে হয়। কারণ অবসর কী তা আমার জীবনে আমি বুঝিনি। আসলে বোঝার সময় পাইনি। কারণ সারাটা জীবনই কেটে গেল এক সমস্যা থেকে অন্য সমস্যার সমাধান খুজতে খুজতে। দুঃখী মানুষগুলোর মুখে একটু যদি হাসি ফোটাতে কথন যে জীবনের অবসর সময়গুলো হারিয়ে ফেলেছি তা নিজেই জানি না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আমি কাজ করে চলছি। হয়তো পরিমানে একটু কম, কিন্তু থেমে নেই একটুও। মাঝে মাঝে ভাবি কবরের কর্মহীন দিনগুলোই বোধহয় মানুষের বড় একটা অবসর সময়।
শেষ বেলায় এতটুকুই বলব কোন জীবনই অমর নয়। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর পরও মানুষ তাদের স্মরণ রাখে যারা নিজেদের জীবন মানুষের সেবায় উৎসর্গ করে। আমি জানি না আমার কাজে একন কিছু ছিল কিনা যা মৃত্যুর পরও মানুষের মনে আমাকে জাগ্রত রাখবে। কিন্তু আমি চেষ্ট করেছি। আর যতদিন বেঁচে থাকব ততদনি চেষ্টা করে যাব মানুষের সেবা করতে, কারণ সবার উপরে মানুষ।
(চলবে—————–)