অসুস্থদের রোজার বিধান
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নরনারীর ওপর রমজান মাসের সিয়াম সাধনা একটি আবশ্যকীয় ইবাদত। বান্দাহর ওপর সামর্থ্যের অধিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর রীতি নয়। (বাকারাহ, ২৮৬)। এ জন্যই তিনি অসুস্থ, মুসাফির, অন্তঃসত্ত্বা, ঋতুবতী এবং সন্তানকে দুগ্ধ পান করানো অবস্থায় মায়েদের ওপর রমজানের সিয়াম পালন ফরজ করেননি। বরং এসব অবস্থায় যতগুলো সিয়াম রাখতে পারবেন না, পরবর্তী সময়ে সমপরিমাণ দিনের সিয়াম পালন করে নিলেই হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাস পাবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হন কিংবা সফর অবস্থায় থাকে, সে পরবর্তী সময়ে সমপরিমাণ দিনের সিয়াম পালন করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কঠিন করতে চান না। (বাকারাহ, ১৮৫)।
রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা মুসাফির, যে নারী সন্তানকে দুগ্ধ পান করায়, তার এবং গর্ভধারিণী মায়ের জন্য সিয়াম স্থগিত করেছেন। (তিরমিজি, নাসায়ি)।
তা ছাড়া এমন রোগী, যার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই এবং যে বৃদ্ধ সিয়াম পালনে অক্ষম, তারা সিয়াম পালনের পরিবর্তে প্রতি সিয়ামের বিনিময়ে একজন মিসকিনকে একবেলা মধ্যম মানের খাবার প্রদান করবেন। এটাই হলো ‘ফিদইয়া’। (বাকারাহ, ১৮৪)।
এমন সব অসুস্থরাই রমজানের সিয়াম কাজা করবেন, সিয়াম পালন করলে যাদের শারীরিক সমস্যা কিংবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে একজন প্র্যাকটিক্যাল মুসলিমের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আর যেসব রোগীর সিয়াম পালনের কারণে তাদের শারীরিক সমস্যা কিংবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে না এবং দিনের বেলায় ওষুধ সেবন, কিংবা ইনজেকশন, ইনসুলিন, ইনহেলার বা ড্রপের মাধ্যমে চিকিৎসা না নিলেও চলে, তারা সিয়াম কাজা করতে পারবেন না। যদি শারীরিক অবস্থা এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, দিনের বেলায় খাবার গ্রহণ না করলে কিংবা এ ব্যবস্থাগুলো না নিলে বিপদ হয়ে যেতে পারে, তবে কাজা করতে পারবেন।
এসব রোগী সিয়াম পালনের নিয়তে সেহরি খাবেন এবং রোজা রাখতে থাকবেন, যতক্ষণ না শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা দেখা না দিলে সিয়াম পূরণ করবেন। অন্যথায় যতগুলো রোজা ভাঙতে বাধ্য হবেন, ততগুলো সুযোগ করে কাজা করে দেবেন, কিন্তু রোগ স্থায়ী হলে (যেমন ডায়াবেটিস) এবং কখনও কাজা করা সম্ভব না হলে ফিদইয়া দিয়ে দেবেন।
কোনো রোগী রোজা কাজা করার আগেই মারা গেলে তার পক্ষ থেকে আত্মীয়রা ফিদইয়া দিয়ে দেবেন। ফিদইয়া না দিয়ে তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করে দিলেও চলবে। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার মা মারা গেছেন, তার ওপর এক মাসের/রমজান মাসের সিয়াম বাকি রয়ে গেছে; আমি কি তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করব? রাসুল (সা.) তাকে তা পালন করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। (বুখারি, মুসলিম, আহমাদ)। অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, যে সিয়াম বাকি রেখে মৃত্যুবরণ করেছে, তার পক্ষ থেকে তার আত্মীয় সিয়াম কাজা করে দেবে। (বুখারি)
উল্লেখ্য যে, সিয়াম অবস্থায় বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ নিয়ে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। কারও মতে, এসব পদ্ধতি গ্রহণ করলে সিয়াম ভঙ্গ হবে, আবার কারও মতে হবে না। তবে সারকথা হচ্ছে, সিয়াম অবস্থায় যে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, ওষুধ শরীরে প্রবেশ করে কিনা। যদি করে, তবে সিয়াম ভঙ্গ হবে। যেমন ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সিয়াম কাজা করতে হবে, যদি শরীরে কিছু প্রবেশ করে, কিন্তু শরীর থেকে কিছু বের হওয়ার কারণে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। (বুখারি)। হাসান বসরি (রা.) বলেন, ড্রপ খাদ্যনালিতে পৌঁছে গেলে সিয়াম কাজা করতে হবে। (বুখারি ৩০/২৮)। রাসুল (সা.) বলেন, (ওজুর সময়) নাকে ভালোভাবে পানি পৌঁছাও, যদি রোজাদার না হও। (আবু দাউদ, কিতাবুস সাওম)। এতে বোঝা গেল, নাক দিয়ে ভেতরে পানি চলে গেলে সিয়াম নষ্ট হবে। সুতরাং ড্রপের ক্ষেত্রেও একই হুকুম। তা ছাড়া কোরআন অসুস্থদের সিয়াম কাজা করার সুযোগ দিয়েছে। আর এসব ব্যবস্থাও তো আমরা অসুস্থতার কারণেই বাধ্য হয়ে নিচ্ছি। (আল্লাহু আ’লাম)
আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে, রমজান মাসে দিনের বেলায় যে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। যেমন সিয়াম অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো জায়েজ হলেও ইবনে ওমর (রা.) রমজান মাসে রাতের বেলায় শিঙ্গা নিতেন।
আরবি প্রভাষক, জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাযিল মাদ্রাসা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী