লকডাউন : দুই মাসে ক্ষতি হবে ২ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় গত ২৬ মার্চ থেকে দেশ লকডাউনে। ফলে সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ থাকায় ভেঙে পড়েছে বাজার ব্যবস্থা। পাশাপাশি বড়, মাঝারি, ছোট সব ধরনের শিল্পখাত বিপর্যস্ত। লকডাউন যদি পুরো মে মাস জুড়ে অব্যাহত থাকে তাহলে মাস শেষে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে দুই লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের মোট উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ। আর দিনে এই ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত এক মাসে আর্থিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে কৃষি খাতে উৎপাদন বন্ধ না হলেও ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত নিয়ে কৃষকরা বেকায়দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ ব্যবসা বাণিজ্যে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে যতো দেরি হবে, আমাদের বাণিজ্য আগের অবস্থানে ফিরতেও ততো দেরি হবে। করোনার কারণে সব ধরনের কল-কারখানাসহ বাইরের সব কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। আগামী ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই ছুটি বহাল থাকবে। প্রায় দুই মাসে বাংলাদেশ কি পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাথমিকভাবে তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের একটি গবেষক দল।
তাদের হিসাবে, ‘লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের কারণে রমজান কেন্দ্রিক ব্যবসায়িক আয়োজন নিষ্প্রভ। রমজানে বিক্রির লক্ষ্যে পণ্য মজুদ করলেও লোকসানের শঙ্কায় আছেন দোকান মালিকরা।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ২০১৮-২০১৯ সালের জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি বা চলতি ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা হিসাব করার একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট থাকে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি কিছুটা উৎসব কেন্দ্রিক। যেমন- পহেলা বৈশাখ, রোজা, ঈদ ও বৌদ্ধপূর্ণিমা এ উৎসবগুলো সার্বজনীন। এ বছর এগুলো কিছু করতে পারেনি। ফলে ক্ষতি হবে কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ আরও বড়। এই ক্ষতির পরিমাণ লকডাউন অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে, যা প্রতিবেদনে এই মুহূর্তের হিসাব করা সম্ভব হয়নি।
আবদুল হামিদ বলেন, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায়। এতে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে এক লাখ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যেহেতু পুরো এপ্রিল মাসকে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা হিসেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে তাই ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন অব্যাহত থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।’
লকডাউন অবস্থা পুরো মে মাস এমনকি জুন মাসেও অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যদি তাই হয় তাহলে মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ।
লকডাউনের অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিতের পাশাপাশি নতুন নতুন উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তার মতে, এই অবরুদ্ধ দশা দীর্ঘস্থায়ী হলে বেশিরভাগ ছোট-খাটো ব্যবসা এবং ছোট পরিসরের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ চেইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটায় প্রবাসী আয়েও ধস নেমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের এ অধ্যাপক বলেন, এই হিসাবটি একদিকে যেমন সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যথেষ্ট কি না তা নিরূপণ করতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদও অনুভূত হবে। তবে ক্ষতি প্রশমনে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে আমদানি-রপ্তানি কমে যাচ্ছে। প্রবাসী আয়েও ধস নামছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমও স্থবির। অর্থাৎ অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে এটি বলা যায়। তবে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থার সৃষ্টি যেন না হয় সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। কিন্তু কি পরিমাণ ক্ষতি হবে সেটা এই মুহুর্তে বলা সম্ভব না। ক্ষতি কাটাতে সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। সেটি যথেষ্ট নয়। তবে প্যাকেজগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনায় ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ এই লকডাউন কতোদিন থাকে আমরা জানিনা। আর আমাদের পুঁজি নেই। তাহলে আমরা কিভাবে এই ক্ষতির হিসাব করবো। প্রায় দেড় মাস ধরে সবধরনের দোকান পাট বন্ধ। তারপরও আমরা একটা হিসাব করেছি৷ তবে এটা চুড়ান্ত নয়। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লাভের ক্ষতি যদি ধরা হয় তারা গড়ে ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করলে আমাদের ৫৬ লাখ ব্যবসায়ীদের প্রতিদিন ১১০০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে। যদি গত মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে মে মাসের ০৯ তারিখ পর্যন্ত ধরা হয় তাহলে মোট ৪৫ দিন হয়৷ সে হিসেবে আমাদের ধারণা মতে ক্ষতি দাঁড়াবে ৪৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, পুরো মে মাস লকডাউন থাকলে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা (গত অর্থবছরের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ) ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ধরে ক্ষতির অনুমিত হিসাব দেওয়া হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। হিসাবে লকডাউনের কারণে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষির প্রধান উপখাতগুলো হল শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য সম্পদ। স্বল্পমেয়াদে এসব উপখাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি-বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় এসব উপখাতের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আর শিল্প খাতে দিনে ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবা খাতে দিনে ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
এদিকে বৈশ্বিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সরকারি প্রাক্কলনের অর্ধেকেরও বেশি কমে ২-৩ শতাংশের মধ্যে নেমে যেতে পারে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ অর্থবছর তা ৮ দশমিক ২ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জিডিপির আকার ছিল ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে ৩ শতাংশ জিডিপি কমলে অর্থবছর শেষে জিডিপি এক লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম হবে। জিডিপি আরও বেশি কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিজিএমইএ দেওয়া তথ্যমতে, গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২০ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু পোশাক খাতেই ক্ষতি হবে ৪২-৪৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সংক্রমণ তীব্র হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। অধিকাংশ কারখানা বন্ধ। শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে কি না সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে শ্রমিকদের বেতন দিতে। এখন রপ্তানিমুখী শিল্পের ৪০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে কারখানা সচল হওয়ার ওপর।
করোনার কারণে লকডাউনে সড়ক নৌপথে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বন্ধ। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, সড়কপথে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার মতো। এ হিসাবে গত প্রায় এক মাসে ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপবিল্ডার্স ইন্ডাস্ট্রিজের দাবি, নৌখাতে ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এ শিল্পের সঙ্গে ২ লক্ষাধিক লোক জড়িত।
বিশ্বব্যাপী যোগাযোগহীনতায় পর্যটনশিল্প ভয়াবহ হুমকির মুখে। পর্যটন ব্যবসা একেবারেই বন্ধ। বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশে এ খাতে তেমন অবস্থান নেই। কিন্তু নির্ভরশীল অনেক খাত ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি রাফেউজ্জামান জানান, পর্যটন শিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি এ খাতের অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এখন বেকার। অচল অবস্থার কারণে জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, বিমান সংস্থা, পর্যটক পরিবহন ও গাইডিং সংশ্লিষ্টরা।
করোনার আঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে বিভিন্ন সময়ে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাস্তবায়ন করবে। বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মূলধনের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) বেড়েছে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের বেতন দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিতে আগের সময়ে সহায়তা দিতে প্রিশিপমেন্ট তহবিল পাঁচ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং নিম্নআয়ের মানুষের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্যাকেজ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও উদ্যোক্তারা বিভিন্ন শর্ত এবং প্রদত্ত সুবিধার পরিমাণ, আওতা ও মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছেন।