ইসলাম ধর্মে রোজার বিশেষ গুরুত্ব
আজ রমজানের তেরতম দিন আর মাগফিরাতের দশকের তৃতীয় রোজা আমরা অতিবাহিত করলাম, আলহামদুলিল্লাহ। রোজা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়টি হলো রোজা। ইসলামী বিধান অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ। আল্লাহর কৃপায় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রমজানের দিনগুলো বিশেষ ইবাদতে রত হন।
বিভিন্ন ধর্মে উপবাস প্রথা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে। তবে সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ ধর্ম ইসলামে এর ধরনটা একটু ভিন্ন। ইসলামের মূল উৎস কোরআন করিম। এতে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)। উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কেবল ইসলামের সাথেই রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং কোরআন করিম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী মাজহাবগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াত থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তাহলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে রোজা অর্থাৎ উপবাসব্রত পালন করা কোন না কোন আকারে সকল ধর্মেই ছিল, আছে। অধিকাংশ ধর্মগুলোতে এবং নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ শ্রেণির কৃষ্টির মধ্যে, উপবাসব্রত একটি সাধারণভাবে নির্দেশিত ব্যাপার। আর যেখানে এই ধরণের নির্দেশ নেই, সেখানেও প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাগিদে অনেকেই উপবাস করে থাকেন।
ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবি করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বর্ত বা ব্রত অর্থাৎ রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতিমাসের ১১ ও ১২ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীয় রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসেব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোজা পাওয়া যায়। কোন কোন ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসের প্রত্যেক সোমবারে রোজা ব্রত পালন করে। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্মমতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলী অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোজা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিশরীয়দের মঝেও রোজাকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রীক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা ‘থাসমো ফেরিয়া-এর তৃতীয় তারিখে রোজা রাখতো। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের ওপর রোজা ফরজ নয় কিন্তু তাদের ইলহামি কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ওপর রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচ বছর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা: ১০ম খণ্ড, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদাশ সংস্করণ)
খ্রিস্টান ধর্মে অ্যাশ ওয়েনেসডে ও গুড ফ্রাইডে’তে রোজা রাখেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। এছাড়া ইস্টার সানডে’র আগের দিন প্রায় ৪০ দিন তারা শুক্রবারগুলোতে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। হজরত ঈসা (আ.)ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন (মথিঃ ৪-২)। হজরত ইয়াহইয়া (আ.) যিনি হজরত ঈসা (আ.)-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কসঃ ২-১৮)
এছাড়া রোজা যে আত্মাকে পবিত্র করে এ সম্পর্কে মথিতে উল্লেখ আছে, এক স্থানে হজরত ঈসা (আ.)-এর নিকট তার অনুসারীরা জিজ্ঞেস করলো যে আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তর সমূহকে কিভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হবো? প্রত্যুত্তরে হজরত ঈসা (আ.) বললেন, অন্তর সমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে দোয়া এবং রোজা ছাড়া দূর করার কোন ব্যবস্থা নেই (মথিঃ ১৭-২১)।
হিন্দু ধর্মের বেদে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রমাসের একাদশীর দিন পুরোটাই উপবাস করতে হবে। শুধু পানি পান করা যাবে। সে হিসেবে মাসে দু’বার এই উপবাসের রেওয়াজ আছে। বৌদ্ধ ধর্মের সব সম্প্রয়েই উপবাসের বিধান রয়েছে। মূলত পূর্ণিমার দিনগুলোতে ও অন্য ধর্মীয় দিনগুলোতে তারা উপবাস করেন।
ইহুদীদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহ্ আরোপিত ফরজ ইবাদত। হজরত মূসা (আ.) কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন (নির্গমনঃ ৩৪-৩৮)। সুতরাং সাধারণভাবে হজরত মূসা (আ.)-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লিশতম দিনে রোজা রাখা ফরজ বা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাতঃ সফরুল আহবারঃ১৬-২৯-৩৪ঃ ২৩-২৭)
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৪)
ইসলাম ধর্মে রোজার গুরুত্ব এ কারণেই অত্যধিক যে, রোজা মানব হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও তাকওয়ার মান বৃদ্ধি করে এবং রোজাদারের যাবতীয় পাপ মোছন করে জান্নাত লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
যেভাবে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা আর উত্তম ফল লাভের বাসনায় রমজান মাসে রোজা রাখে, তার পূর্বের সর্বপ্রকার পাপ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি ও মুসলিম)।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কোরআন করিমের সুরা বাকারার ১৮৩ আয়াতটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তবে ইসলাম ধর্ম এই উপবাস ব্রতের মধ্যে নবরূপ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য তুলে ধরেছে। ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। তাই ইসলামেই রোজাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে একে পালনের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
তাই যিনি রোজা রাখেন, তিনি তার অসাধারণ আত্মত্যাগের এবং তার প্রস্তুতির কথা আল্লাহপাককে জানিয়ে দেন আর তার হৃদয় এই ঘোষণাও দেয় যে, আমি কেবলমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখছি। এছাড়া তার হৃদয় এটাও বলে যে, যেহেতু আমি আল্লাহর জন্য রোজা রাখছি এবং সকল প্রকারের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করছি তাই প্রয়োজনবোধে আমি আমার প্রভু ও সৃষ্টিকর্তার খাতিরে আমার সবকিছু, এমনকি আমার জীবন পর্যন্ত কোরবানি করে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হবো না।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে রমজানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রোজা রাখার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট
সূত্র- ইত্তেফাক