সংক্রমণের দীর্ঘ চক্রে যাচ্ছে বাংলাদেশ!
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ছুটির মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু আগামী ১০ মে থেকে খুলছে হাটবাজার, ব্যবসাকেন্দ্র, দোকানপাট ও শপিং মল। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে চারটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তবে এতে করে করোনাভাইরাসে বিস্তার ঠেকানো যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলছে, তারা এখনই ঢালাওভাবে দোকানপাট খোলার পক্ষে নন, এ বিষয়ে রোগতত্ত্ববিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন সংক্রমিত মানুষ যতজন মানুষের সংস্পর্শে আসবেন ততজনই আক্রান্ত হবেন। লক্ষণ উপসর্গ ছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত একজন কোনও জনসমাবেশ, পোশাক কারখানা বা শপিং মলে গিয়ে যতজনের সংস্পর্শে আসবেন ততজনকেই সংক্রমিত করবেন। এতে করে বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি চক্রে যাচ্ছে। এ থেকে খুব সহজে নিস্তার মিলবে না বলেও মন্তব্য তাদের।
এদিকে মঙ্গলবার ( ৫ মে) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর পোশাক কারখানা খোলায় এবং দোকানপাটে আনাগোনা বেড়ে যাওয়াতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের সংক্রমণ বাড়ছে, গত আট-১০ দিন ধরে দেখেছি, চার থেকে পাঁচশ’ রোগী হতো, কিন্তু এখন ছয়শ’ ছাড়িয়ে গেছে, আজ সাতশ’ ছাড়িয়েছে। এখন মার্কেট খোলা হয়েছে, গার্মেন্ট খোলা হয়েছে, দোকানপাটে আনাগোনা বাড়ছে, কাজেই সংক্রমণ যে একটু বৃদ্ধি পাবে, এটা আমরা ধরেই নিতে পারি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, যতই সীমিত আকারে বলা হোক না কেন, দোকান, শপিং মল খুলে দিলে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ বেড়ে যাবে। লক্ষণ-উপসর্গ নেই এমন করোনা আক্রান্ত মানুষ যত জায়গাতে যাবেন তিনি সেখানেই মানুষকে সংক্রমিত করবেন। আর স্বাভাবিক কারণে যখন সব খুলে দেওয়া হবে তখন মানুষের চলাচল বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ ছোট একটি দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন দেশের আনাচে-কানাচে এটা ছড়িয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ সংক্রমণের চক্রে যাচ্ছে। ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এখন যতদিন সংক্রমণ আছে ততদিন যদি কষ্ট করে লকডাউন যদি করা যেত তাহলে সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা যেত—যেটা এখন আর থাকছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা তথ্য হচ্ছে, একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি তার সংস্পর্শে আসা গড়ে আড়াইজন ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারেন।
বাংলাদেশে এই হার একই রকম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইইডিসিআর-এখন পর্যন্ত যে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে সেখানে এই হার মোটামুটি একইরকম। আক্রান্ত রোগীর কন্টাক্টে থাকা সদস্যদের নমুনা নিয়েছে আইইডিসিআর। সেখানে দেখা গেছে, সংক্রমিত কোনও ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবার, অফিস বা ক্লোজ কন্টাক্ট রয়েছে এমন মানুষদের মধ্যে গড়ে আড়াইজনকে সংক্রমিত করছেন, শতকরা হিসেবে সেটা ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এটা আন্তর্জাতিকভাবে যে আড়াইজনের হিসাব প্রায় সে রকম।
সীমিত আকারে শপিং মল খুলে দিলে বাংলাদেশের কত মানুষ সংক্রমিত হতে পারে প্রশ্নে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যদি এখন থেকেই প্রশাসন খুব কড়া না হয় তবে খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যাচ্ছি আমার। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটা খারাপ চিত্র পাওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে করে স্বাস্থ্যবিধি কতোটা মানা হয়েছে—আমি খুব সন্দিহান। কারণ কারখানাগুলোতে সংক্রমণ হচ্ছে, পুলিশ ব্যারাকে সংক্রমণ হচ্ছে। ঈদ মার্কেট এই কথাটা বলা যাবে না। কেবলমাত্র জরুরি প্রয়োজনে দোকান খোলা রাখা যেতে পারে, কিন্তু এখনই যেভাবে রাস্তায় ভিড় হচ্ছে সেরকম হলে আমাদের দুর্ভাগ্য আসতে আর বেশি বাকি নেই।
আমরা বোধহয় করোনা ভাইরাসের সঙ্গেই বসবাস করতে চাই এই মনোভাবেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে—মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পোশাক কারখানা, শপিং মল খুলে দিয়ে লকডাউন করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তার নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, পোশাক কারখানা, শপিং মল খুলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, কিন্তু সেটা বাধ্য হয়ে। সেটা হলেও একজন সংক্রমিত ব্যক্তি যত মানুষের মধ্যে চলাফেরা করবে তিনি ততজনকেই সংক্রমিত করবেন—এটাই আমাদের জন্য ভয়াবহ। এক দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, যেটুকু শিথিল করা হয়েছিল এরপরে আর কিছু শিথিল করার আগে অবশ্যই অ্যাপিডেমিওলজিক্যাল ট্রেন্ড অর্থাৎ সংক্রমণের ধারা কী সেটা লক্ষ্য করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছি। তিনি বলেন, এই বিষয়ে ডে টু ডে সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে। রোগী বাড়ছে, আমরা এখনই ঢালাওভাবে দোকানপাট খোলার পক্ষে নই। তারপরও কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রোগী বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রোগতত্ত্ববিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সীমিত আকারে খাদ্যের জন্য ট্রেন ও ট্রাক চালু করা গেলেও কোনোভাবেই যেন যাত্রীবাহী ট্রেন ও বাস যেন না খোলা হয়। জীবন-জীবিকা অবশ্যই ফ্যাক্টর, কোটি কোটি মানুষকে ‘রিসোর্স লিমিটেড কান্ট্রি’ খাওয়াতে পারবে না, তাই এ দুইয়ের ব্যালেন্স করতে হবে। তাই রোগতত্ত্ববিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, কতটুকু লকডাউন করতে হবে, কতটুকু না করলেও চলবে। আর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শক কমিটির রোগতত্ত্ব বিষয়ক সাব-কমিটি খুব শিগগিরই আমাদের জানালে আমরা সেটা সরকারকে জানিয়ে দেবো।
বিশ্বে কোনও মহামারির সময় একজন থেকে সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে কতজনের মাঝে সে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে সেটা নির্ধারণ করা হয় R0 (আর নট-রিপ্রোডাকশন নম্বর)-এর ভিত্তিতে। বিশ্বজুড়েই সংক্রামক রোগের ভয়াবহতা ও সে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতাকে এই নম্বর দিয়ে যাচাই করা হয়।
একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে কতজন সংক্রমিত হতে পারে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, এটা নির্ভর করে কন্টাক্টের ওপর, তবে বলা হচ্ছে সাধারণত একজন সংক্রমিত ব্যক্তি দুই থেকে তিন দশমিক ৫৮ এর মতো মানুষকে সংক্রমিত করে। তিনি বলেন, সব দেশের পরিকল্পনা হচ্ছে সংক্রমণ হার একজন থেকে ১ জনে নামিয়ে আনা। দুইজন পর্যন্ত থাকলে সেটা মহামারি। আর সংক্রমণ একজন থেকে একজনে নামিয়ে নিয়ে আনা গেলে সেটা সহনীয়।
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন