রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সাত বছর, অগ্রগতি নেই বিচারে
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সপ্তম বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। সাত বছর আগে দেশের পোশাক শিল্পে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় এই ট্র্যাজেডি গোটা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দেয়। ২০১৩ সালের এ দিনে সাভারে ধসে পড়েছিল ৯ তলা ভবন রানা প্লাজা। ইট কংক্রিটে চাপা পড়ে হারিয়ে যায় অনেকগুলো তাজা প্রাণ। জীবন ফিরে পেলেও শত শত শ্রমিককে পঙ্গুত্ব মেনে নিতে হয়েছে। ঘটনার সাত বছর পার হয়ে গেলেও এ ঘটনায় হতাহত শ্রমিক ও তার স্বজনেরা এখনও সুবিচার পাননি। বিচার হয়নি অভিযুক্তদের।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক একটি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে।
সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়েছে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত। এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আর একটি মামলা চলমান আছে।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, মামলাটি বন্ধের আগে বদলি হয়ে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে এসেছে। আশা করছি শিগগিরই এ মামলার বিচারকাজ শুরু হবে।
দুদকের মামলায় বিচার হলেও ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তবে অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
জানা যায়, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত থাকায় পুরো সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া স্থগিত আছে।
রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকি আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৩২ জন, পলাতক ছয়জন এবং মারা গেছেন দুইজন।
সোহেল রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মূল মামলার অভিযোগ গঠন হয় চার বছর আগে। ঘটনার পরপরই রানাকে গ্রেপ্তর করা হয়। এর মধ্যে কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি, তাকে জামিনও দেওয়া হয়নি।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, হাইকোর্ট এ মামলার অভিযুক্ত ৮ আসামির কার্যক্রম স্থগিত করেছিল। ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। বাকি দুজনেরটা দ্রুতই প্রত্যাহার হবে বলে আশা করছি। এরপরই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।
রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। সেসব রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন আসামির মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে। তাই এ মামলায়ও সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত আছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুলের আশা শিগগিরই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাকে তো জানাতে হবে যে মামলাটিতে কার কার বিচার এখানে স্টে রয়েছে। না জানালে আমি কি করতে পারি?’
বিষয়টি জানানোর দায়িত্ব কার- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘যে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে তাদের বাদ দিয়ে যাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত নেই তাদের বিচার শুরু হতে তো বাধা নেই।’