বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভোলার বেতুয়া-মনপুরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে নৌযান চলাচল বন্ধ
সংবাদ করাই আমাদের কাজ, আপনাদের ‘জ্বললে’ কী করবো?
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০। তার আগের বছর ছিল ১৪৬। লেখার শুরুতেই তথ্যটি দিয়ে বোঝাতে চাইলাম, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আমাদের দেশে দিনকে দিন কোথায় গিয়ে ঠেকছে। সবক্ষেত্রে উন্নয়ন হলেও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও জীবনমানের যে খুব একটা উন্নতি হয়নি, তা এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই জানেন। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, গত শুক্রবার মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে মারধর করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের সাজা দেওয়া হয়। এ বিষয়টি নিয়ে গতকাল থেকে গণমাধ্যমে বেশ তোলপাড় চলছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের নজরে বিষয়টি এসেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভাগীয় তদন্ত করছে। আজকে আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে কারাদণ্ড প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ জনকে রিটে বিবাদী করা হয়। বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদের পক্ষে আইনজীবী ইশরাত হাসান জনস্বার্থে রিটটি দায়ের করেন। ইতোমধ্যে আরিফুল ইসলামের জামিনও হয়েছে। এখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আমাদের সহকর্মী হিসেবে আইনি পদক্ষেপ যা যা নেওয়া প্রয়োজন আমরা নেবো, আরিফের পাশেও থাকবো। তবে আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাই। গত কয়েক মাসের মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আমরা দেখেছি। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ আরেকটি ঘটনা ঘটেছে এই মাসেই। ১০ মার্চ বকশিবাজারের বাসা থেকে বের হওয়ার পর ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের আর কোনও সন্ধান পায়নি তার পরিবার। তার আগে ৯ মার্চ শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন মাগুরা-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর। ওই মামলায় শফিকুল ইসলাম কাজলকে তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে। যদিও আমরা জানি না, ওই মামলার সঙ্গে তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টির কোনও যোগসূত্র আছে কিনা।
প্রশ্ন হলো, সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই আমরা সংশয় প্রকাশ করে থাকি। নির্যাতন-নিপীড়ন সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করে সাংবাদিকতা পেশা টিকে আছে। বিশেষ করে, আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের সংগ্রাম সবচেয়ে বেশি। স্বল্প বেতন ও সারা দেশ থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও তারা সংবাদ পাঠান। সেখানে সরকারি প্রশাসন যদি তাদের ওপর অসন্তুষ্ট থাকেন, আর প্রতিশোধপরায়ণ হন, তাহলে পরিস্থিতি হবে আরিফের মতো। একজন ডিসি কতটা ক্ষমতাধর, তার উদাহরণ আরিফের এই ঘটনাটি প্রমাণ করে। গভীর রাতে বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢোকা, গায়ে হাত তোলা, ডিসি অফিসে নিয়ে জামা-কাপড় খুলে পেটানো, তারপর কোর্ট বসিয়ে মাদক মামলায় শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া—এসব এক ভয়ঙ্কর ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের বার্তা দেয়।
মনে প্রশ্ন জাগে, আরিফ একজন সাংবাদিক বলে বিষয়টি আমরা জানলাম, কিন্তু যিনি সাংবাদিক নন, সাধারণ কেউ, তাদের কারও সঙ্গে যে এমন ভয়াবহ প্রভাব দেখানো হয় না—তার নিশ্চয়তা কী? আমরা সব সময় মনে করি রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রশাসনই একটা ‘দানবে’ রূপ নিচ্ছে । ভয়ঙ্করভাবে তারা প্রভাব ও ক্ষমতা প্রদর্শনের নজির রাখছেন। একজন ডিসি একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে করতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় কোনও সম্পত্তি কি কোনও সরকারি কর্মকর্তা নিজের নামে করতে পারেন? এটা তো বেআইনি। আরিফ এই বিষয়েই প্রতিবেদন করেছিলেন। সাংবাদিকরা এ ধরনের প্রতিবেদন তো রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যই করেন। যেন রাষ্ট্র ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়। এ ধরনের অপকর্ম যেন বন্ধ হয়ে যায়। তখনই যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিসিকে জবাবদিহির আওতায় আনা হতো, তাহলে আজ আরিফের এই হাল হতো? এর দায় তো তাহলে রাষ্ট্রেরও।
কোন শক্তিবলে সরকারি কর্মকর্তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন? কেন তাদের কিছুই বলা যাচ্ছে না? আমরা প্রায়ই দেখি কেউ অপরাধ করলে তাকে ওএসডি করা হয়, কিংবা তাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। অথচ এ ধরনের অপরাধ কেন ফৌজদারি অপরাধ হয় না? কেন বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হয় না? এসব প্রশ্নই এখন উত্থাপনের সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হয় দেশের জনগণের টাকায়। তারা যেখানে জনগণকে সম্মান দেখাবে, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় জনগণের পাশে থাকবে, তা না করে তারা জনগণকে নিচু শ্রেণি বিবেচনা করে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব যেন আমরা দেখেও না দেখার ভান করে বসে আছি।
আমি বলছি না সব সরকারি কর্মকর্তা কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের মতো। অবশ্যই অনেক ভালো-সৎ-নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু যখন প্রকাশ্যে এ ধরনের অপরাধ কেউ করেন, তখন তার বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির ব্যবস্থা নিতেই হবে। একজন সাংবাদিকের কাজ সংবাদ পরিবেশন করা। কারও যদি সেই সংবাদ পছন্দ না হয়, কিংবা কেউ যদি মনে করেন তার বিরুদ্ধে সংবাদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা মিথ্যা, তাহলে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদলিপি দিতে পারেন, আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারেন। কিন্তু এসব না করে কারও ঘরে জোরপূর্বক প্রবেশ করে মারধর করা, অন্ধকারে কোর্ট বসিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে শাস্তি দেওয়া কোনও সভ্য রাষ্ট্রের কাজ নয়।
শেষে শুধু বলতে চাই, আরিফকে যখন মারা হচ্ছিল, তখন বারবার বলা হচ্ছিল—‘কয়দিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছিস’। সাংবাদিকের কাজ সংবাদ করা। আমরা জনগণের কাছে, পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার জন্য সংবাদ করলে কেউ যদি জ্বালাতন মনে করেন—তাহলে দুঃখিত, আমাদের কিছু করার নেই।
লেখক: সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন