ভোলার-৪ আসনের এমপি জ্যাকবের কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম-দূর্নীতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন

ভোলা জেলার আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী ও সর্ব শ্রেণীর ঠিকাদারদের পক্ষে চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় কার্যাদেশ পাওয়ার পরও কাজ করতে না দেয়া, চাঁদা আদায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারী বৃহষ্পতিবার সকালে ভোলা প্রেসক্লাবের হল রুমে এ সংবাদ সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সন্মেলনে ভোলা জেলা ঠিকাদারদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন আওয়ামীলীগ নেতা ও প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার মো: রুহুল আমিন কুট্টি। সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, অবস্থান ধর্মঘট, স্থানীয় এলজিইডিসহ বিভিন্ন দপ্তর ঘেরাও, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানবন্ধনসহ ৫ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন তিনি।
ভোলা জেলার ৭ উপজেলার মধ্যে কেবল মাত্র চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় কাজ করতে গেলে প্রতিটি কাজের জন্য ২০ ভাগ কমিশন ও বিভিন্ন মহলকে চাঁদা দিতে হয় উল্লেখ করে রুহুল আমিন কুট্টি বলেন, কমিশন ও চাঁদা দিতে গিয়ে অনেক ঠিকাদার আজ নিঃস্ব। বিগত ১১ বছরে এভাবে কমিশন আদায় করে হাজারো কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বিরুদ্ধে। স্থানীয় উপজেলা প্রকৌশলী ও চিহ্নিত দুই একজন এমপি’র পক্ষে কমিশনের টাকা আদায় করে থাকেন। কমিশনের টাকা না দিলে কোনো ঠিকাদারকে চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় এলাকায় কাজ করতে দেয়া হয় না। এমন কর্মকান্ডের প্রতিবাদে গত ১০ ফেব্রুয়ারী এলজিইডি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে স্মারক লিপি প্রদান করা হয়।


তিনি বলেন, বর্তমানে ঠিকাদাররা ই-লটারীর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ পাচ্ছেন। গত অক্টোবর মাস থেকে চলতি সময় পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজের কার্যাদেশ থাকার পরও তাদের কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। স্থানীয় এমপির পক্ষে চরফ্যাশন উপজেলা প্রকৌশলী মোশারেফ হোসেন ও মনপুরা উপজেলা প্রকৌশলী মকবুল হোসেন সহায়তা করার অভেযোগ উঠে। প্রকৌশলী সরাসরি বলেন, স্থানীয় এমপির কমিশনের টাকা পরিশোধ করে তার কাছ থেকে অনুমতি বা সবুজ ছাড়পত্র আনার জন্য। অনুমতি না আনলে কাজ শুরু করতে দেয়া হবে না। এখন অনেক কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারদের কাজ বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এলজিইডি’র জিওবি মেন্টেনেজ, ভি.আর.আর.পি, ভোলা ও বরিশাল প্রোজেক্টসহ অন্যান্য দফতরের তথ্য উল্লেখ করে কুট্টি বলেন, জেলার ৫টি উপজেলায় যথা সময়ে কাজ শুরু হয়েছে। এমনকি কোন কোন উপজেলায় কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলায় ভোলার ঠিকাদারদের কাজ করেত না দেয়ায় তার অগ্রগতির শুন্য পার্সেন্ট।
অপরদিকে চরফ্যাশন ও মনপুরায় কাজ করতে গেলেই এমপি পালিত ক্যাডার বাহিনী হুমকীর মুখে পড়তে হয় ঠিকাদারদের এমন কথা উল্লেখ করে ঠিকাদারার বলেন, চরফ্যাশন ও মনপুরায় তোমরা টেন্ডার দিতে কে বলেছে এমন হুমকি ও দেয় এমপি। আমরা তার প্রতিবাদ করলে চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামীলীগ একটি প্রেসকনফারেন্স করে বিষয়টিকে রাজনীতির রং দেয়ার চেস্টা করা হয়। যা অত্যান্ত নিন্দনীয়, রাজনৈতিক মিথ্যাচার।


তিনি বলেন, এটা আমাদের পেশাগত দাবি আদায়ের আন্দোলন। কারো হুমকী বা ধামকীতে তা বন্ধ হবে না। বা আমরা পিছু হোটব না। তাদের এ সব কর্মকান্ডের আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামীলীগ একজন দুর্নীতিবাজ সংসদ সদস্যের পক্ষে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে পারেন কিনা, তা জেলা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে প্রশ্ন রেখে ব্যবস্থা নিতে দাবি জানাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিচার দাবি করছি।
চরফ্যাশন ও মনপুরা নিয়ে ভোলা-৪ আসনে উন্নয়নের নামে যে লুটপাট ও সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার কয়েকটি নমুনা হচ্ছে- চরফ্যাশন ও মনপুরার মোট ৪০ টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে এমপি জ্যাকবের নিজের ও স্বজনদেও তত্তাবধানে চলছে ১৩ টি ইট ভাটা। এগুলোর বেশির ভাগ ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে সরকারি বনের গাছ দিয়ে। এলাকার প্রচলিত কথা, সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, বন মন্ত্রী বলে হিসেবে এলাকায় খ্যাত। তাই বলা হয় চরফ্যাশন মনপুরার সব বন তার। সব গাছ তার। ব্রিক ফিল্ড (ইট ভাটা) তার। তাই বনের গাছ কেটে এনে ইটভাটায় পোঁড়াতে কারো অনুমতি লাগে না। উন্নয়ন কাজের জন্য এমপির নির্ধারিত ইটভাটা থেকে চড়া মুল্যে ইট কিনতে হচ্ছে সাধারন ঠিকাদারদের। এটাই এই এলাকার নিয়ম। এসব কারণে বাইরের (অন্য এলাকার) ঠিকাদারকে কাজ করতে দেন না এমপি সাহেব। কেননা তিনি নিজেই ঠিকাদার। ওই এলাকায় ১১ বছরে যে সব কাজ হয়েছে, তার ঠিকাদার এমপি নিজে ও তার ভাই সৌরভ ও তার ম্যানেজার পৌর মেয়র বাদল কৃষ্ণ দেবনাথ।
এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ১১ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। মাত্র এইচএসসি পাশ করা হলেও ক্ষমতার আমলে রাতারাতি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করার দাবির পেছনে জাল সনদের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মামলাও হয়েছে।


২০০৭ সালে জ্যাকব সাহেব, ঢাকার ইষ্টার্ন ব্যাংক দিলকুশা শাখা থেকে পারসোনাল লোন চেয়ে যোগ্যতার অভাবে লোন পান নি। সেই জ্যাকব সাহেব রাতারাতি অঢেল টাকা ও সম্পদের মালিক কি ভাবে হলেন ? এমপি জ্যাকবের দাবী তিনি গত ১২ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে এর মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকার কাজ তিনি ও তার ব্যবসায়িক পাটনাররা করেছেন। ভিন্ন দলের নেতাকে তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে তাদের নামে টেন্ডার দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইউনুছ আল মামুন, এমরান বকসি, মিলন, ভাই সৌরভ, মেয়র বাদল কৃষ্ণ দেবনাথসহ এমন কয়েক জনের নামে ৫ হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারী কাজ করা হয়। দুলারহাট সড়ক ১ বছরে ২ বার মেরামত করার নামে নজির বিহীন দূর্নীতি করা হয়েছে। এইসব কাজের টাকা জ্যাকব সাহেবের পকেটে যায়।
অনিয়িম ও দুর্নীতির আরেকটি চিত্র হচ্ছে- ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে কাঁচা মাটি ফেলে সড়ক নির্মাণ। একই সঙ্গে ঐ রাস্তায় ইটের খোয়া ও পিচের রাস্তা করা হয়, যা ইতিহাসে নজির বিহীন। জোর করে দখলে নেয়া ৫০ একর জমির উপর নির্মিত খোয়াব বাড়ি (খামার বাড়ি) এখন বিনোদনবাড়ি হিসেবে খ্যাত। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নায়িকারা এখানে এসে সময় কাটান। গাজিপুরেও রয়েছে একই স্টাইলের প্রমোদবাড়ি। ঢাকার মিরপুরে ইন্টোরিয়ার ডিজাইনে বিদেশী মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মাণ করা পাঁচ তারা প্রাসাদসম অট্টলিকা রয়েছে এমপি জ্যাকবের। এসব বাড়ি নির্মাণে টাকার উৎস কোথায় ? মধুমতি ব্যাংকের শেয়ার কিনে রাতারাতি মালিক বনে গেছেন আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।
উপমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। চরফ্যাশনের পৌরসভার মার্কেটের ষ্টল বরাদ্ধের নামে হাতিয়ে নেওয়া হয় কয়েক কোটি টাকা। এলাকার একই উন্নয়ন কাজ জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও এলজিইডির অর্থায়নের করার নজির রয়েছে। ওভারলেপিং করা শুধুমাত্র নাম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা।
এলাকার কোন জেলে, জেলে পরিবার, দুঃস্থ্য পরিবার, হতদরিদ্র পরিবার, সরকারের বরাদ্ধকৃত জিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ, সুবিধা পায় নি। স্থানীয় উন্নয়নের টি.আরের বরাদ্ধসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের নামে বরাদ্ধকৃত হাজার হাজার টন গম ও চাল বিক্রি করে ঐ টাকা হাতিয়ে নেন এমপি জ্যাকব। চাল বিক্রির করার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি রয়েছে। যাদেরকে সাবাই চেনেন। এদিকে চাল না পেয়ে জেলেদের বিক্ষোভ করার ঘটনাও এলাকায় রয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানরা এসব ক্ষেত্রে অসহায়। ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার নামে মোটা অংকের বাণিজ্য করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এভাবেই রাতারাতি তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এ পর্যন্ত সরকারি অর্থ ব্যয় করে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এইসব প্রতিষ্ঠান নিজের নামে, স্ত্রীর নামে ও পিতা মাতার নাম করা হয়। জাতীর পিতার নামে গড়ে তোলেন নি কিছুই। অথচ বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে নিবাস গড়ে তোলার নাম দিয়ে কোটি কোটির টাকার বরাদ্ধ এনে তা আত্মসাত করা হয়। এলাকার খাস মহল মসজিদের জমিতে গড়ে তোলেন জ্যাকব ওয়াচ টাওয়ার।
চরফ্যাশনের ঠিকাদারেরা যদি ভোলা-১, ভোলা-২, ভোলা-৩, সংসদীয় আসন এলাকায় এসে নির্বিঘেœ ও বিনা বাধায় ঠিকাদারী কাজ করতে পারেন, সেখানে ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন ও লালমোহন উপজেলাসহ দেশের অন্যান্য জেলার ঠিকাদারগণ কেন ভোলা-৪, সংসদীয় আসন এলাকা গিয়ে (চরফ্যাশন-মনপুরা) কাজ করতে পারবে না ? কেন তাদেরকে কমিশন দিতে হবে ? কেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে সবুজ সিøপ (গ্রীন কার্ড) নিতে হবে ? এমন প্রশ্ন সাংবাদিকদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে চাই।
জ্যাকবের চাদাবাজি, দুর্নীতির বিচার না হলে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, অবস্থান ধর্মঘট, স্থানীয় এলজিইডিসহ বিভিন্ন দপ্তর ঘেরাও, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানবন্ধন আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষনা করেন।
বক্তব্য পাঠ করেন ভোলা ঠিকাদার এসোসিয়েশন এর আহবায়ক রুহুল আমিন কুট্টি। এ সময় বক্তব্য রাখেন যুগ্ম-আহবায়ক মোঃ জুলফিকার, সদস্য আবু ছায়েম, রাজ্জাক, ইভান, টুয়েল, হোসাইন সাদী। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঠিকাদার ইলিয়াস, আবিদ, আব্দুস সহিদ, তুহিনসহ ভোলার অধিকাংশ ঠিকাদাররা এবং ভোলার সকল মিডিয়া কর্মীরা।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।