আজহারীর নেতৃত্বে ধর্মান্তরিত ১২ জনকে ভারতে ফেরত পাঠানোর নেপথ্যে
বাংলাদেশের আলোচিত-সমালোচিত ইসলামি বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ মাহফিলে যে ১২ জন ভারতীয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ধর্মান্তকরণ নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর একই পরিবারের ওই ১২ জনকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বিবিসি বাংলার এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একসঙ্গে ১২ জনের ভারত থেকে এসে অবৈধভাবে বসবাস, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং সর্বশেষ দেশে ফেরত পাঠানোর নেপথ্য কাহিনী।
লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া গ্রামে গত শুক্রবার মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজে ১২ জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একই পরিবারের এ ১২ জন ভারত থেকে এসেছিলেন, ভারতে তারা হিন্দু ধর্মালম্বী ছিলেন।
একসঙ্গে ১২ জনের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার খবর সারা দেশ জুড়ে বেশ আলোচিত হয়। পরে পুলিশ তাদের আটক করে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তারা দুই মাসের ভিসাতে বাংলাদেশে আসলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। আর এ কারণেই তাদের ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
লক্ষীপুরে যা ঘটেছিল
লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া গ্রামে গত শুক্রবার স্থানীয় মসজিদ কমিটি আয়োজিত মাহফিলে ওয়াজ করেন মিজানুর রহমান আজহারী। বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় এ বক্তাকে নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কও রয়েছে। বিতর্ক থাকলেও তার ওয়াজে প্রচুর মানুষ হাজির হন।
গত শুক্রবার লক্ষীপুরের সেই মাহফিলে একটি পরিবারের মোট ১২ জন সদস্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এর আগেও মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলে ধর্মান্তকরণের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিতর্ক চলছে।
লক্ষীপুরের ঘটনায়ও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশ। অনুসন্ধান শেষে পুলিশ জানতে পারে, এই পরিবারটি ভারত থেকে এসেছে। তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকছে। তবে ওয়াজ মাহফিলটির আয়োজকরা বলছেন, তারা জানতেন না যে পরিবারটি ভারত থেকে এসেছে।
পরিবারের সঙ্গে মনির হোসেন
পরিবারটির পরিচয়
নতুন ইসলাম গ্রহণ করা এই পরিবারের প্রধানের নাম মনির হোসেন। ভারতে তার নাম ছিল শংকর অধিকারী। পুলিশ জানিয়েছে, গত বছরের আগস্ট মাসে দুই মাসের ভিসা নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছিল এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল।
লক্ষীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) এ এইচ এম কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, ধর্মান্তরের ঘটনার পর তদন্ত করে পরিবারটির কর্তাব্যক্তি সম্পর্কে তারা বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘এই পরিবারটির কর্তা বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার নাম মনির হোসেন। তাদের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, মনির হোসেন ছোটবেলায় হারিয়ে যান। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি কীভাবে ভারতে গেছেন, তা তার জানা নাই। ভারতে হিন্দু পরিবারে বড় হয়েছেন এবং হিন্দু নারী বিয়ে করে সংসার করছিলেন। তিনি ভারতে নাম নিয়েছিলেন শংকর অধিকারী।’
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘এই ব্যক্তির স্ত্রী দুই জন এবং দুই ঘরে সন্তান সংখ্যা আটজন। একজন নাতিও আছে। তাদের সবাইকে আমরা ভারতীয় পাসপোর্টসহ পাই। বেনাপোল বন্দর দিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেদিক দিয়েই তারা আবার ফেরত গেছেন।’
মনির হোসেনের মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে কথা হয় বিবিসি বাংলার। তিনি লক্ষীপুরের রামগঞ্জের চন্ডীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (ইউপি মেম্বার)।
ফাতেমা বেগম জানান, তার ছেলে হারিয়ে যাওয়ার ২৫ বছর পর গত বছরের জুলাই মাসে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। ঘটনাটি ছিল নাটকীয়। সে সময় শুধু গ্রামের নামে বা ঠিকানায় মোবাইল নম্বর দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল মনির। একজন পোস্টমাস্টারের চেষ্টায় সেই নম্বরের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হয়। এরপর তার ছেলে মনির পরিবার নিয়ে গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে আসেন।
ফাতেমা বেগম জানিয়েছেন, তার ছেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাংলাদেশেই থাকতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি বলেছেন, মাহফিলে তার ছেলে কীভাবে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছেন তা তার জানা নেই।
ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দুই বউসহ সন্তানদের নিয়ে আসার পর তারা হিন্দু হওয়ায় আমি তাদের আমার সাথে না থেকে অন্য এলাকায় থাকতে বলেছিলাম। তারা কেরানীগঞ্জে বসবাস করছিল ছয় সাত মাস ধরে। তারা মক্তবে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং এরপর তাদের ওই মাহফিলে নিয়া কালিমা পড়ায়।’
ধর্মান্তকরণ নিয়ে বিতর্ক
আজহারীর মাহফিলে ধর্মান্তরকরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তাদের জোর করে বা এ ঘটনা সাজানো কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
তবে মাহফিলে আয়োজকদের অন্যতম একজন মোহাম্মদউল্লাহ দাবি করেছেন, পরিবারটিকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে তারা জোর করেননি। তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারেও জানা ছিল না বলে তিনি দাবি করেন।
মোহাম্মদউল্লাহ বলেন, ‘পরিবারটির কর্তা মাহফিলের একদিন আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। এরপর মাহফিলের দিন তারা এফিডেভিটের কপিসহ আইনজীবী নিয়ে এসেছিলেন। তাদের আইনজীবী ধর্মান্তরিত হওয়া সর্ম্পকিত সেই এফিডেভিট মাহফিলে পড়ে শোনান।’
তিনি বলেন, ‘তারা মিজানুর রহমান আজহারীর কাছে ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজহারী সাহেবকে যখন আমরা প্রস্তাব দেই, তখন উনি অপারগতা প্রকাশ করেন। কারণ কিছুদিন আগেও এরকম একজন বোন ধর্মন্তরিত হয়েছিলেন এবং তা নিয়ে আজহারী সাহেবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছিল। সেজন্য আমরা মঞ্চে থাকা আরেকজন আলমকে দিয়ে ওই পরিবারকে কালিমা পড়ানো হয়েছিল।’
লক্ষীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘কেউ তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে, এমনটা আমরা পাই নি। কেউ বাধ্য করলে তখন আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এখানে তাদের ধর্মান্তরিত হওয়া না হওয়া আমাদের কাছে বিষয় ছিল না। আমাদের বিষয় ছিল, তারা ভারতীয় নাগরিক হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিল।’
সূত্র আমাদের সময়