সর্বশেষঃ

নির্বাচন ঘিরে সিম ক্লোনিং চক্র সক্রিয়

দুয়ারে চলে এসেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরেও প্রতারণার জাল বিছিয়েছে ডিজিটাল প্রতারকচক্র। ঢাকার দুই সিটিতে অংশগ্রহণকারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে তারা সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের সিম ক্লোনিং-স্পোফিং করতো। তারপর টার্গেট প্রার্থীকে ‘বিশেষ ক্ষমতাবলে’ নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়াসহ নির্বাচনী প্রচারণায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের আভিযানিক ঝামেলামুক্ত রাখার কথা বলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়।

ডিজিটাল এ প্রতারক চক্রের মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদে পড়ে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারিত হয়েও নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে কেউ চেপে গেছেন বিষয়টি; কেউ হয়েছেন আইনের দ্বারস্থ। এর আগেও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশের আইজি, ডিসি, ওসিদের মোবাইল নম্বর কপি তথা ক্লোন করে স্পুফিং প্রতারকরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে- যা গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা গেছে।

মোবাইল সিম ক্লোনিং প্রতারক চক্রের আশ্বাসের খপ্পরে পড়ে কিছুদিন আগে ৫ লাখ টাকা খুঁইয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী (স্বতন্ত্র) মো. ইয়াসিন মোল্লা। রাজধানীর আদাবর থানার ওসির মোবাইল সিম ক্লোনিংয়ের পর নম্বর স্পোফিং করে প্রতারণা করা হয় এ প্রার্থীর সঙ্গে।

এ বিষয়ে গত শুক্রবার আদাবর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা (নম্বর-২২) করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী ইয়াসিন মোল্লার ছেলে মো. কাওসার মোল্লা। গতকাল রবিবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ডিজিটাল এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

মামলার এজাহারে কাওসার মোল্লা উল্লেখ করেন, গত বুধবার সকালে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ইয়াসিন মোল্লার ব্যক্তিগত গ্রামীণ নম্বরে একটি গ্রামীণ নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়-‘আমি ওসি আদাবর থানা, আমি আপনার জন্য নির্বাচনে কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু আপনার জন্য একটি পথ তৈরি করে দিই। আপনি সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০-এ আদাবর থানা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলেন।’

এরপর মামলার বাদী কাওসার মোল্লাকে ওসি পরিচয়দানকারী তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর (একটেল) থেকে কাওসারের বাবাকে একটি বাংলালিংক নম্বর দিয়ে বলে যে- এটি ম্যাজিস্ট্রেটের নম্বর। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ওই বাংলালিংক নম্বর থেকে ইয়াসিন মোল্লার নম্বরে ফোন দিয়ে বলে, ‘আপনি কি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০২০ এ জয়ী হতে চান? যদি হতে চান তা হলে আপনাকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। নির্বাচনের আগে ৫ লাখ টাকা এবং পাস করার পর বাকি ১০ লাখ টাকা দিতে হবে।’

তখন কাউন্সিলর প্রার্থী ইয়াসিন মোল্লা রাজি হয়ে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ভাই ভাই মেডিক্যাল হলের বিকাশ এজেন্ট গ্রামীণ নম্বর থেকে বিকাশ করা পৃথক ১১টি একটেল নম্বরে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা (যথাক্রমে-৫৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা), দুটি এয়ারটেল নম্বরে ৬০ হাজার টাকা এবং একটি বাংলালিংক নম্বরে ৩০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। টাকা পেয়ে বুধবার সন্ধ্যায় ফের ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়দানকারী ব্যক্তি তার বাংলালিংক নম্বর থেকে ফের ফোন করে বলে যে ‘আপনাকে আরও ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে।’

বিষয়টি কাউন্সিলর প্রার্থী ইয়াসিন মোল্লার সন্দেহ হলে তিনি ওসি আদাবরকে ফোন দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত খুলে বললে ওসি বলেন, ‘আমি এইসব বলি নাই।’ ওসি আদাবর দ্রুত থানায় আসতে বলেন ইয়াসিন মোল্লাকে। পরে ওসির সঙ্গে কথা বলে ওই কাউন্সিলর প্রার্থী বুঝতে পারেন যে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। প্রতারক ০১৬১৬৭২৪১১২ নম্বর থেকে ইয়াসিন মোল্লাকে বারবার ফোন দিয়ে কথা বলে। আসামি বা আসামিরা ওসি আদাবরের সরকারি মোবাইল নম্বর ০১৭১৩৩৭৩১৮৩ ক্লোন করে ওসি আদাবর থানা ও ম্যাজিস্ট্রেটের মিথ্যা পরিচয়ে ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে কাউন্সিলর প্রার্থী ইয়াসিন মোল্লার কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়।

থানায় মামলা হলেও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন মামলার বাদী কাওসার মোল্লা। গত শনিবার রাতে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ডিজিটাল এ প্রতারকরা আদাবর থানার নাম্বার ক্লোন করে আমাদের ফোন দিয়ে বলে যেÑ আমরা নির্বাচনে পাস করিয়ে দিব, আরও কত প্রলোভন। প্রশ্ন রেখেছিলাম, আপনারা নির্বাচনে পাস করাবেন কিভাবে। তখন ওপাশ থেকে বলা হয় টাকা দিলে আমরা নির্বাচনে পাস করায়ে দিতে পারব।

প্রতারক চক্রটি টাকার বিষয়ে যখন আমাদের কাছে প্রস্তাব করেছে, সাথে সাথে আমরা থানায় জানিয়েছি। এ বিষয়ে আমরা লিখিত অভিযোগ করিনি, তবে মৌখিকভাবে ওসি সাহেবকে জানিয়েছি। শুধু আমরাই না, আরও কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীও ভুক্তভোগী। তারাও থানায় অভিযোগ করেছেন বলেও কাওসার মোল্লা জানান।

অভিযোগের প্রসঙ্গে গতকাল ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। কিন্তু তারা এ ধরনের প্রতারণার শিকার হননি বলে জানিয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার এসআই মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা যায়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে আর কেউ অভিযোগ করেছে কিনা? জানতে চাইলে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, মোবাইল সিম কার্ডের অবিকল প্রতিরূপ তৈরিই হলো সিম ক্লোনিং। স্পোফিং এমন একটি কৌশল যা কম্পিউটারে অননুমোদিত অ্যাক্সেস লাভ করে, যার দ্বারা অনুপ্রবেশকারী একটি কম্পিউটারে বার্তা পাঠিয়ে আইপি ঠিকানা দিয়ে নির্দেশ করে- যে বার্তা বিশ্বস্ত হোস্ট থেকে এসেছে। স্পোফিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে যে কারও মোবাইল নাম্বার তৈরি করে সেই নাম্বার দিয়ে ফোন দেওয়া যায়। এতে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ অতি সহজে বিভ্রান্ত হয়ে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে দেয়। অন্যের মোবাইল নম্বরের মতো নম্বর বানিয়ে পরিচিতজনদের ফোন করা বা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির নম্বর কপি করে ফোন করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করাই স্পোফিং প্রতারক চক্রের মূল উদ্দেশ্য।

প্রতারণা ছাড়াও টার্গেট ব্যক্তির মোবাইল সিমের তথ্য সংগ্রহ বা চুরি, ছিনতাই করে মোবাইল সিম নিয়ে ক্লোন করে প্রতারণা, হুমকি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর ঘটনাও ঘটছে সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে। এছাড়া ক্লোন করা মোবাইল সিম দিয়ে এসএমএস বা কল-লগ অথেনটিকেশন নির্ভর যে কারও ফেসবুক আইডি, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি হ্যাক করা সম্ভব।

অন্যদিকে, মেসেজিং অ্যাপ আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা দখলে নিয়ে নিতে পারবে ডিজিটাল এ প্রতারকরা। সিম ক্লোন করে প্রতারকরা এখন আর শুধু হুমকি ধমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবা তথা মেসেজিং অ্যাপসেও নজর রাখছে। সুযোগ পেলেই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ব্যক্তির ইমেজ ও সামাজিক অবস্থানও ধ্বংস করতে পারে। রাষ্ট্রের জন্যও ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে সিম ক্লোনকারীরা।
advertis

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।